আস্তে কন কত্তা!
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল উত্তরপ্রদেশের মত বড় রাজ্যসহ তিনটিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিজেপি। এতে তাদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কিন্তু আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রলাপ বকলেই মুশকিল! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের দলের এই বিজয় সম্পর্কের নানা কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি কথা শুনে বা টিভির স্ক্রলে দেখে অনেকেই নিজেদের কান এবং চোখকে চট করে বিশ্বাস করতে পারেননি। ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে। কথাটি কী ? মোদীজি বলেছেন, "জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে এটা উন্নয়নের জয়।"
এই ধরনের কথা শুনে, বহু ব্যবহারে জীর্ণ হলেও, সকলেরই সেই প্রবাদটির কথাই মনে পড়বে -- ভূতের মুখে রামনাম! যাদের রাজনীতির ধর্মই হলো ধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো, তারা বলে কিনা জাতপাতের বিরুদ্ধে উন্নয়নের জয়! যে যোগীজিকে মোদীজি উত্তরপ্রদেশের কুর্সিতে বসিয়েছেন, সেই যোগী নামক নরাধমের নিকৃষ্টতম উক্তিটি -- কবর থেকে নারীকে তুলে ধর্ষণের নিদান -- নিশ্চয়ই সবাই এখনও বিস্মৃত হননি! এই যোগী নামক ভোগিজী ২০১৪ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ইউপিতে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাড়ার কারণ সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বৃদ্ধি! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে বলেছিলেন, "গ্রামে যদি একটি কবর থাকে তাহলে একটি শ্মশানও থাকা দরকার।" তার দলের গেরুয়াধারী সাংসদ তথা নেতা সাক্ষী মহারাজ আরও এক কাঠি সরেস। তিনি বলেছিলেন, জমির অপচয় কমাতে মুসলিমদেরও দেহ দাহ করা উচিত। শ্মশান ও গোরস্থান নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করার পর এবছর নির্বাচনের প্রাক্কালে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ফতেহপুরের এক সভায় বলেন -- "রমজান মাসে যদি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকতে পারে তাহলে দেওয়ালির সময়ও থাকতে হবে।" সারা বছর ধরে সমস্ত মানুষের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। আর সরকারি ক্ষমতা তাদেরই হাতে। তাহলে রমজান আর দেওয়ালি আসছে কোথা থেকে? উত্তর কারো অজানা নয়। আসছে শুধুমাত্র অনৈতিক বিদ্বেষজীবী রাজনৈতিক মস্তিষ্ক থেকে।
এনডিটিভির এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা ২১ বার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করেছেন। পরবর্তী চার বছরে অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ওই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২৪ । রাজনৈতিক মতলবে প্রচারিত এই ঘৃণা বা হেট স্পিচে জড়িত ৩৪ জন (৭৭ শতাংশ) বিজেপি নেতা, অন্যান্য দলের নেতা রয়েছেন ১০ জন (২৩ শতাংশ)। কোন ক্ষেত্রেই কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা -- না দলীয় স্তরে, না আইনি স্তরে -- গ্রহণ করা হয়নি! এর পরেও চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে মোদীজি বলছেন, জয় উন্নয়নের! স্বনামখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায় জীবিত থাকলে নির্ঘাত বলতেন - "আস্তে কন কত্তা, শুনলে ঘুড়ায়ও হাসব!"
১৫ মার্চ ২০২২
(লেখাটি সংবাদ-সাহিত্য সাপ্তাহিক ঝড় পত্রিকায় 'মুখ ও মুখোশ' কলামে প্রকাশিত।)