ভুল করলেও কম্যুনিস্টরা স্বীকার করে।

লিখেছেন- অধ্যাপক সুশান্ত কর


google keyword



ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়'! 'এই স্বাধীনতা মিথ্যে! ' বাংলাতে তাই তো হবে? কেন যে লোকে হিন্দিতেই কথাটা স্মরণ করেন! 'এই স্বাধীনতা মিছা '! অসমিয়াতে এটাই হবে। কিন্তু বিষ্ণু বাভাও বুঝি হিন্দিতেই বলেছিলেন 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়'! আমরা কেমন যন্ত্রের মতো ভাবি --তাই না? কম্যুনিস্টরা বলেছিলেন!
কিন্তু কম্যুনিস্টরা যন্ত্র থাকেন না। আর যন্ত্রই কি হালনাগাদ না হয়ে থাকে? তবে মানুষ কী করে থাকবে? তাই কম্যুনিস্টদের কেউ এখন আর কথাটা বলেন না। বিপ্লবী কম্যুনিস্টরাও না। কম্যুনিস্টরা ভুল করে এবং স্বীকার করে। ভুল না করা কিছু যন্ত্র মানব সেসব কথা নিয়ে খুূব হাসিঠাট্টা করে। গর্দভেরা কি খবর রাখে নিজেরাও কত পাল্টে পাল্টে গেছে? শুধু স্বীকার করবার সততাটা নেই। তাই বলে কমিউনিস্টদের বলবার সবটাই কি ভুল ছিল? সবেতেই কি ভারত রাষ্ট্রও সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন? কেইনসিও অর্থনীতি অনুসরণ করবে না নয়া উদারবাদী পথ ধরবে --স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল? আফগানিস্তান থেকে এই সেদিন আমেরিকা সরে দাঁড়াবার বিরুদ্ধে গলা চড়াতে পেরেছিল? এমন শত সহস্র নজির দিয়ে বলা চলে দেশটি পুরোটা স্বাধীন নয়।
কিন্তু গলা কতটা চড়াবে না চড়াবে এখন ভারত রাষ্ট্র ঠিক করতে পারে। আর সেই রাষ্ট্রের সরকার নির্বাচনে লোকে যে ভোট দেয় তাতে দেশের বড়লোকের টাকা আর প্রতিপত্তির একটা বড় প্রভাব থাকে বটে --তবু লোকে ভোট দেয়। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষিত আর পয়সাওয়ালারা ছাড়া কেউ ভোট দেবার অধিকার পায় নি। দেশ এক থাকবে না ভাগ হবে --সেই সিদ্ধান্তও তারাই নেয়। গরীব আর অশিক্ষিতদের এবং মেয়েদের কেউ মুখের কথাটাও জিজ্ঞেস করে নি। যদিও সেই নিয়ে রায়ট করে মরেছে গরিবেরাই চিরদিন। মেয়েদের গর্ভ চিরে সন্তান বের করে আগুনে ফেলে দেবার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এই যে গরিবে তখন মত দেবার স্বাধীনতা পায় নি, তাতেই লোকে মুর্খের মতো তর্ক করে দেশ স্বাধীন করলেন কে? গান্ধি সুভাষ না নেহরু? নিজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নই নেই এই সব অশিক্ষিত শিক্ষিত জনেরও! আরে সব ধারা শতমতের তর্কে ও কর্মে তো মিলেমিশে একাকারও হয়েছিল! নইলে আম্বেদকরেরই বা সেই স্বাধীনতার সংগ্রামে আলাদা কী ভূমিকা ছিল? দলিতদের কথা ভেবেছিলেন বলে সংবিধান প্রণেতা সমিতির চূড়োতে তিনিও তো বসেছিলেন। তিনি কি প্রশ্ন করেছিলেন, যে আগে ঠিক হোক --দেশ স্বাধীন করলেন কে?

নেতাজি যখন আই এন এ গড়ে যুদ্ধ করছিলেন দেশের ভেতরে কোথাও কোনও আলোড়ন ছিল না। দেশ তখন ভারত ছাড়োতে ব্যস্ত। আর বহু ভেতো বাঙালি তখন জাপানি বোমার ভয়ে কাঁপছে। দেশ তো গর্জন করে উঠল তখন, যখন আই এন এ বন্দি মুক্তির দাবিতে দেশের সব পতাকা এক হয়ে পথে নেমে গেল। এমনিতেই সারা বিশ্বে যুদ্ধোত্তর ব্রিটিশের তখন সূর্যাস্ত হবে, আমেরিকা ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলছে। ওরা এতো চাপ নেবে কী করে? ভয়ে মরছিল যদি সেনা শ্রমিক আর কৃষকের জোটে না ক্ষমতার রাশ টেনে নিয়ে দেশে ও বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদেরই কেবল না পুঁজিবাদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। পাশেই তো তখন চিনা শ্রমিক আর কৃষকেরা একের পর এক বিজয় অর্জন করে চলেছে। ব্রিটিশের কী পাড়ার রামাদা সেলিমদার মতো এতোসব না দেখলে চলে? তারা যতটা পারে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে যাদের হাতে ক্ষমতা যেভাবে দেওয়া যায় দিয়ে চলে গেছে! আর কার হাতে দিতে পারত? জবাব আছে কি কোনও? এমন ঘটনা কি কেবল ভারতেই ঘটেছে? গোটা এশিয়া আফ্রিকাতে লাতিন আমেরিকাতে তাকান সাম্রাজ্যবাদের এর পরে চেহারা বদল হতে শুরু করে। যেখানেই জেদাজেদি করছিল ঔপনিবেশিক শক্তি সেখানেই সমাজবাদী পতাকা উড্ডীন হয়েছে। চতুর ব্রিটিশ তার কোনও উপনিবেশেই এটা হতে দেয় নি। দিয়েছে? স্মরণ করুন! আধা দুনিয়া ওদের দখলে ছিল। তার পর কী হল? লোকে যাতে হাতে কেবল পতাকা বা অস্ত্র নিয়েই কথা বলে না -- সংসদে বিধানসভাতেও গিয়ে দরকারে হামলা করে-- ব্রিটিশ আদলেই ভারতীয় সংবিধান দেশের অশিক্ষিতম দরিদ্রতম লোককেও সেই অধিকার দিয়ে দিল। তাতে এখনও বহু মধ্যবিত্ত কেমন চটে দেখবেন! 'প্রগতিশীলতা'র দাবীদারেরাও আছেন সেই দলে! অশিক্ষিতদের তারা এখনও গোলাম ভাবে। ভোট দিক! কিন্তু ভোটে দাঁড়িয়ে সংসদে যেন না যায়! ভাবখানা এমন যেন দেশের সব বিড়ম্বনার জন্য দায়ী এই অশিক্ষিতরা। এমন কি সেই সব নারীরা!
ফরাসী বিপ্লবের 'সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা'র স্লোগান মনে পড়ে? সেই বিপ্লবের অতি বিপ্লবী --যার নিষ্ঠা সততা নিয়ে প্রশ্নই তোলা যাবে না; কিন্তু গিলোটিনে হত্যার নীতি চালু করে নিজেও গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছিলেন --সেই রোবেসপীয়র এবং অনুগামীরাও নারীকে ভোট দেবার ও ভোটে দাঁড়াবার যোগ্য ভাবেন নি। বিশ শতকের সমাজবাদী শ্রমিক আন্দোলনের আবহে নতুন করে ইউরোপে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠলে ফ্রান্সের মতো দেশ সেই অধিকার স্বীকার করে ১৯৪৪এ মাত্র। তার দশক না পার করতেই স্বাধীন ভারত সেই অধিকার অর্জন করে ১৯৫২-র প্রথম নির্বাচনেই। আর আজকাল কিছু অকৃতজ্ঞ দেশপ্রেমী নারী বেরিয়েছেন যারা দাবি করেন ভারত তো স্বাধীন হল ২০১৪তে মাত্র। কিছু গর্দভ বামপন্থীও আছেন বটে, অভিমান করে বসে আছেন --১৯৪৭ এ হোক আর ২০১৪তে। আমাদের তাতে কী? দেশ তো এখনও পুঁজিবাদীদেরই দখলে! সেই সব অভামানী বামেদের কে বোঝায় সে তো বাপু, তোমাদের সাধের রাশিয়া, চিন আর ভিয়েতনামটাও এখনও পুঁজিবাদীদেরই দখলে। তার বেলা? এই করে তোমরা দেশ দখলে নেবে? বহু আঁকা বাঁকা পথ পার করতে হয় বলে নিজেরাও মুখ বাঁকা করে রাখবে। আর আশা করবে, লোকে মুগ্ধ হয়ে সেই মুখে চুমু খাবে? যেটুকু অর্জন দেশের জনতার রয়েছে সেগুলোকে যখন গেরুয়ারা কেড়ে নিতে চাইছে তাদের সুরে ও স্বরে স্বর মিলিয়ে? সমালোচনার বামদিকে আর ডান দিকে কোনও তফাৎ থাকবে না?

কমিউনিস্টরা সেদিন স্বাধীনতাকে মানে নি আরও স্বাধীমতা, আরও গণতন্ত্র আরও সাম্য চাই বলে। কিন্তু এখন যারা সেই স্বাধীনতাকে 'অমৃত মহোৎসবের' নামে কালিমা লিপ্ত করতে চাইছে --তাদের তো চাই আরও পরাধিনতা, আরও স্বৈরতন্ত্র, আরও বৈষম্য। তাদের ঠেকানোর কাজটা করতে গেলে গান্ধি নেহরু সুভাষ অথবা দেশের তখনকার সব দলের যৌথমঞ্চ কংগ্রেসের সমালোচনাতে ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হবার না। কংগ্রেসের অপরাধ কী ছিল জানেন তো? এরা ডান বাম সবার সঙ্গে আপোস করেছিল। নইলে শ্যামাপ্রসাদের মতো জনসমর্থন বিহীন লোক মন্ত্রী হতে পারত? কিন্তু লোকটির মতাদর্শের বিরুদ্ধে কংগ্রেস লড়েওছিল। গান্ধিকে এরা খুন করেছিল। কারণ তিনি পাকিস্তান যেতে চাইছিলেন। আশা ছিল, দেশটা আবার এক হবে। উদ্বাস্তুর ঢল তাঁকে ভাবাচ্ছিল। আর শ্যামাপ্রসাদ? দেশটাকে এক করবার ভাবনা থাকত তবে বাঙালি উদ্বাস্তুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তা না করে কাশ্মির গেছিলেন আগুনে ঘি ঢালতে। আর সেই ঘি এখনও এরা ঢেলেই চলেছেন। আর দেশের মানুষের জীবনকে বানিয়ে চলেছেন নরক।

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post