অর্ক ভাদুড়ির লন্ডনের ডায়েরি

জেরেমি করবিনের সাক্ষাৎকার নিতে নিতে প্রায় ঘণ্টাখানেক টিউবে জার্নি করব, কখনও ভাবিনি। গতকাল আচমকাই সেই অভিজ্ঞতাটা হয়ে গেল!
নর্থ লন্ডনে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম৷ করবিনও ছিলেন৷ ইসলিংটন নর্থের সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা ওঁরা প্রশ্ন করছিলেন হাউজিং-এর সমস্যা নিয়ে, স্কুলের ফি্ নিয়ে, বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে। করবিন উত্তর দিচ্ছিলেন। বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা ছিলেন৷
করবিন বলছিলেন, চ্যারিটি খুব ভালো কাজ, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। এমন একটা ব্রিটেন গড়ে তোলা দরকার, যেখানে চ্যারিটির প্রয়োজন থাকবে না। বলছিলেন বড়লোকদের উপর ট্যাক্স বাড়ানোর কথা, শ্রমিকদের অধিকারের কথা।
জেরেমি করবিনের সাথে অর্ক ভাদুড়ি

প্রোগ্রামের শেষে কফি খেতে খেতে কথাবার্তা হচ্ছিল ওঁর সঙ্গে। আমি প্রশ্ন করছিলাম, করবিন উত্তর দিচ্ছিলেন। একটানা কথা নয়, ছেঁড়া ছেঁড়া। মাঝখানে অন্য অনেকে ঢুকে পড়ছেন৷ কথা বলছেন। এক সময় করবিন বললেন, "অর্ক, আমার আরেকটা প্রোগ্রাম আছে৷ যেতেই হবে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগছে। তুমি তো বললে প্যাডিংটন ফিরবে৷ আমার সঙ্গে যাবে? আমি ওদিকেই যাব।"
আমি তো একপায়ে খাড়া। ভেবেছি, ওঁর গাড়িতে যেতে যেতে বাকি সাক্ষাৎকারটুকু সেরে নেব। ও মা! দেখি ভদ্রলোক বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন! বৃষ্টির মধ্যে। একা একা৷ আমিও কথা বলতে বলতে হাঁটছি। ভাবছি গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করে রেখেছেন হয়তো।
কোথায় কী! দেখি হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধ সামনের টিউব স্টেশনে ঢুকলেন৷ কথা বলতে বলতে আমিও ঢুকলাম। স্টেশনের লিফটে একজন বৃদ্ধার ছাতা পড়ে গেল। করবিন নিজেই তুলে দিলেন৷ ভদ্রমহিলা গদগদ৷ জেরেমির হেলদোল নেই৷ কথা বলে চলেছেন। করবিনকে দেখে লোকজন এগিয়ে এসে কথা বলছেন, সেলফি তুলছেন। উনি হাসছেন৷ কোনও বিরক্তি নেই৷ একজন বললেন, "আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের হাল বদলে যেত.."। করবিন বললেন, " ওই জন্যই হতে পারলাম না.."৷ ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা চলছে।
টিউবটা ফাঁকা। আমরা কয়েকজন যাত্রী। সকলে করবিনকে গোল করে ধরে বসলেন। আমি প্রশ্ন করছি ব্রিটিশ লেফটের উত্থান আর আদৌ সম্ভব কি না, উনি কি লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে লড়বেন? জানতে চাইছি চলমান যুদ্ধ নিয়ে ওঁর মতামত৷ কথা হচ্ছে কলকাতা নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর নরেন্দ্র মোদীর উত্থান নিয়ে। বাকি যাত্রীরা এসে কথা বলছেন। একজন আরব মহিলা ওঁর হাতে ধরে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য৷ একজন কমবয়সী মেয়ে "জেরেমি, তুমি খুব সেক্সি" বলায় উনি হেসে তার বয়ফ্রেন্ডের নাম জিজ্ঞেস করলেন।
লোকে এসে জিজ্ঞেস করছে, "মিস্টার করবিন, আপনি সিকিউরিটি নেন না!" উনি বলছেন, "খামকা নেব কেন! এই তো দিব্যি আছি! প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে নিতেই হত.. ভাগ্যিস হইনি.."। আমি প্রশ্ন করলাম কমিউনিস্টদের মতো টুপি কেন পরেন, ফুটবল দেখেন কি না। অনর্গল আড্ডায় কখনও ব্রিটিশ বামপন্থার 'মিলিট্যান্ট' পর্ব, কখনও ট্রটস্কিপন্থী রাজনীতি, কখনও ওঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু তারিক আলির কথা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, " জেরেমি, তুমি কি কমিউনিস্ট, মার্কসবাদী?"
টানা প্রায় একঘণ্টার কথাবার্তার শেষে করবিন বললেন, লেন ম্যাকল্যাস্কির সঙ্গে যৌথভাবে লেখা নতুন কবিতার বইটি আমায় উপহার দিতে চান। এখন সঙ্গে নেই, পরেরবার মনে করে আনবেন।
বইটির নাম 'পোয়েট্রি ফর মেনি'। যে ভদ্রলোক টানা ৪০ বছর ধরে পার্লামেন্টের সদস্য, যিনি পর পর দু'বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন, নিজের অবস্থান থেকে একচুলও না সরায় যিনি লেবার পার্টিতে ব্রাত্য, সেই জেরেমি করবিন 'কমিউনিস্ট' কি না আমি জানি না, কিন্তু নিঃসন্দেহে মাটির খুব কাছাকাছি থাকা একজন রাজনৈতিক কর্মী।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় আলাপের সুযোগ পেয়েছি। নেপালের মাওবাদী গেরিলা থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী, শ্রীলঙ্কার জেল থেকে পালিয়ে সমুদ্রপথে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়া বামপন্থী নেতা, রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে ঢুকে পড়া বিপ্লবী, তামিল গেরিলা, কুর্দিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রামী, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নির্বাসিত বিপ্লবীদের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। কিন্তু জেরেমি করবিনের মতো এতখানি মাটির মানুষ, এত প্রাণবন্ত, এত সহজ কাউকে আগে কখনও দেখেনি।
এই অভিজ্ঞতা বড় সম্পদ হয়ে রইল।

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post