অ্যালান উইনিংটন দুর্দান্ত সাংবাদিক: অর্ক ভাদুড়ির লন্ডনের ডায়েরী

ব্যাটল অফ কেবল স্ট্রিট। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে পূর্ব লন্ডনের সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের এক আশ্চর্য দলিল। এই ম্যুরাল ১৯৩৬ সালের সেই প্রতিরোধের স্মরণে।
ওসোয়াল্ড মোসলে ছিলেন ব্রিটিশ ইউনিয়ন অফ ফ্যাসিস্টের প্রতিষ্ঠাতা। আশ্চর্য চরিত্র। সুদর্শন৷ অসাধারণ বাগ্মী। অভিজাত পরিবারের সন্তান। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগের হোতা লর্ড কার্জনের জামাই। ১৯২৪ সালে ভারতে এসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর কিছুদিন কনজারভেটিভ পার্টি করতেন। তারপর লেবার পার্টি। অবশেষে ১৯৩২ সালে তৈরি করেন ব্রিটিশ ইউনিয়ন অফ ফ্যাসিস্ট। এক সময় মোসলেকে মনে করা হত ব্রিটেনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী।
১৯৩৬ সাল। জার্মানিতে ক্ষমতায় হিটলার। ইটালিতে মুসোলিনি। ব্রিটেন, ফ্রান্সের নাকের ডগায় ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াচ্ছে নাৎসি আর ফ্যাসিস্টরা। পৃথিবী একটু একটু করে এগোচ্ছে মহাযুদ্ধের দিকে।
ব্রিটেনেও ভীষণ সক্রিয় মোসলের ফ্যাসিস্ট দল। বিভিন্ন এলাকায় তাদের সঙ্গে সংঘাত হচ্ছে কমিউনিস্ট এবং সমাজতন্ত্রীদের। গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেশ শক্তিশালী। ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিরও যথেষ্ট শক্তি। তাঁরা সাধ্যমতো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন ব্রিটিশ ফ্যাসিস্টদের।

অক্টোবরের ৪ তারিখে পূর্ব লন্ডন অভিযানের ডাক দিলেন মোসলে। লন্ডনের এই এলাকায় প্রচুর ইহুদির বসবাস। মুসলিম জনসংখ্যাও অনেক। কমিউনিস্ট পার্টিরও শক্ত সংগঠন। উত্তেজনা ছড়াতে খুব অঙ্ক কষেই এই এলাকাকে বেছে নিয়েছিল ফ্যাসিস্টরা। অন্যদিকে বামপন্থীরা স্থির করলেন, যে কোনও মূল্যে মোসলের অভিযান রুখতেই হবে। এলাকায় এলাকায় প্রচার হল কয়েকদিন ধরে। ট্রেড ইউনিয়নগুলি বিশেষ উদ্যোগ নিল পাল্টা জমায়েতের।
দুপুর গড়াতেই মোসলের ডাকে হাজার হাজার ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ট কালো ইউনিফর্মে সেজে নেমে এল রাস্তায়। তাদের উল্টোদিকে ব্যারিকেড তৈরি করে দাঁড়িয়ে সর্বস্তরের ফ্যাসিবিরোধী জনতা। পরিস্থিতি সামলাতে কয়েক হাজার পুলিশ ছিল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই নয়। শুরু হল হাতাহাতি লড়াই। কেবল স্ট্রিটের সরু রাস্তার দু'ধারে, অল্ডগেটের আশেপাশে, এখনকার আলতাব আলি পার্কের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সংঘর্ষ। পাথর, হকি স্টিক থেকে শুরু করে আবর্জনা, বালতি- সব কিছু নিয়ে হাজার হাজার জনতার এমন মুখোমুখি লড়াই লন্ডনের ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিল ফ্যাসিস্টরা। কর্মসূচি স্থগিত রেখে ফিরে গিয়েছিলেন মোসলে। যদিও কেবল স্ট্রিটের পর ফ্যাসিস্টদের শক্তি কমেনি, বেড়েছিল। ঠিক যেমন বেড়েছিল কমিউনিস্টদের শক্তিও।
কেবল স্ট্রিট নিয়ে অজস্র লেখাপত্র আছে। পপুলার কালচারেও ঢুকে পড়েছে এই সংঘর্ষের ইতিহাস। মর্নিং স্টার বা মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরির আর্কাইভ ঘাঁটলে এত কিছু নজরে আসে যে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। একটা অতিকায় স্ট্রিট ফাইটকে কেন্দ্র করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও দিস্তে দিস্তে কাগজপত্র তৈরি করেছিল।
মোসলে তো বিখ্যাত লোক। কিন্তু কেবল স্ট্রিটে তাঁর প্রতিপক্ষরাও ছিলেন জবরদস্ত। আশ্চর্য বর্ণময় সব চরিত্র। বিল আলেকজান্ডার ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়েছেন। দাপুটে সংগঠক। ফেনার ব্রুকওয়ে ছিলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির নেতা। সমাজতন্ত্রী। কলকাতায় জন্ম। আজীবন লড়াই করেছেন শান্তির পক্ষে, উপনিবেশের বিরুদ্ধে। ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন দৃঢ়ভাবে। ইন্ডিয়া লিগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেনিয়ার মাও মাও আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পেয়েছেন আটের দশকে। কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু কেজিবির এজেন্ট হিসাবে তাঁকে সন্দেহ করতেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা।
ছিলেন জ্যাক কমার। দুর্ধর্ষ ইহুদি গ্যাংস্টার৷ ইস্ট লন্ডনের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন এক সময়। লন্ডনের অপরাধ জগতের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র। ছিলেন ফিল পিরাটিন। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে ভোটে জিতে পার্লামেন্টে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন লন্ডনে বৃষ্টির মতো বোমা পড়ছে, একঝাঁক অসহায় নাগরিককে নিয়ে অভিজাত স্যাভয় হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে পড়েছিলেন পিরাটিন। সরকারকে বাধ্য করেছিলেন আক্রান্ত নাগরিকদের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলি খুলে দিতে।
আর ছিলেন অ্যালান উইনিংটন৷ অনেকটা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো জীবন। দুর্দান্ত সাংবাদিক। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হ্যারি পলিটের কাছের লোক। ডেইলি ওয়ার্কারের এশিয়ার সংবাদদাতা হিসাবে চীন বিপ্লব কভার করতে যান৷ জন রিড যেমন রুশ বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্বের দিনগুলি দেখেছেন, উইনিংটনও তেমন। মাও সে তুং, চৌ এন লাই, চু তে, লিন বিয়াও-সহ সব প্রথমসারির চীনা কমিউনিস্ট নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কোরিয়া যুদ্ধ কভার করতে গিয়ে জীবনের মোড় ঘুরে যায় তাঁর। অস্ট্রেলিয়ার সাংবদিক উইলফ্রেড বার্চেট এবং উইনিংটন মিলে গোটা পৃথিবীর সামনে যুদ্ধের অন্য দিক তুলে ধরেন৷ দক্ষিণ কোরিয়ার নৃশংসতা এবং গণকবরের সচিত্র প্রতিবেদন 'আই স দ্য ট্রুথ ইন কোরিয়া' প্রকাশিত হলে হইচই পড়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার উইনিংটনের পাসপোর্ট রিনিউ করে না৷ তিনি পরিণত হন রাষ্ট্রহীন এক ব্যক্তিতে।
চীনে থাকাকালীন আশ্চর্য সব কাজ করেছেন উইনিংটন। দক্ষিণ চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল কমিউনিস্ট পার্টি। উইনিংটন সেই সংগ্রামের ডকুমেন্টেশন করেন। চীন-বার্মা সীমান্তে থাকতেন ওয়া জনগোষ্ঠীর মানুষজন৷ তাঁরা ছিলেন হেড হান্টার। মানুষ শিকার করে মাথা কেটে নিতেন। খবর পেয়ে উইনিংটন সেখানে পৌঁছে যান। তাঁদের মধ্যে থাকতে শুরু করেন। প্রথম সাদা চামড়ার মানুষ যিনি ওই এলাকায় গিয়ে বেঁচে ফিরেছিলেন। সেই সব অভিজ্ঞতার সংকলন 'স্লেভস অফ দ্য কুল মাউন্টেন'। উইনিংটনের আত্মজীবনীর নাম 'ব্রেকফাস্ট উইথ মাও'। শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতাদের পাশাপাশি সম্পর্ক ছিল দলাই লামার সঙ্গেও! কতখানি দক্ষ সাংবাদিক ছিলেন সহজেই বোঝা যায়।
ছয়ের দশকের মাঝামাঝি চীন ছাড়তে হয় উইনিংটনকে৷ সময়টাও খুব চিত্তাকর্ষক। চীন-সোভিয়েত বিবাদ। আর্ন্তজাতিক কমিউনিস্ট শিবিরে মহাবিতর্ক। দেশে দেশে দল ভাঙছে৷ হ্যারি পলিটের সাহায্যে উইনিংটন চলে গেলেন ইস্ট জার্মানিতে৷ বাকি জীবনটা সেখানেই।

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post