ভয় !

                                          ভয় !     
                                                      সালাম

সন্ধ্যা হতে এখনও বেশ কিছু সময় বাকি আছে।
- খোকা কোথায় গেলি? একটু এদিকে আয়।
খোকা, বয়স দশ বছর। বাড়ি থেকে একটু দূরে বন্ধুদের সঙ্গে টিপ্পি খেলছিল। 
খোকার মা খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে বলল- এই খোকা। খোকা।
  খোকার সেদিকে কর্ণপাত করার সময় নেই। খেলাতে ভীষণ ব্যস্ত।
এবার খোকার মা বেশ বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বলল-" শুনতে পাচ্ছিস না? সেই তখন থেকে ডাকছি...."
   খোকা হাতের টিপ্পি ফেলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে তেমনি ধমকের সুরে বলল -"আমাকে খেলার সময় ডাকছো কেন? আমি এখন কোথাও যাবো না"
- "না বাবা অমন করিস না। তোর মামিরা এসেছে। ঘরে কিছু নেই দুটো ডিম এনে দে সোনা। এখনও সাঁঝ লাগেনি"
ডিম আনার কথা শুনতে খোকাসহ উপস্থিত সকলের মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
খোকাদের সদ্য গড়ে ওঠা ছোট্ট পাড়া। এখনো কোন দোকান গড়ে ওঠেনি।  মূল  পাড়া থেকে এই পাড়া কে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বিশ্বাসদের একটি বাগান। সেই বাগানে রাস্তার ধারেএকটি তেঁতুল গাছ আছে। অনেকদিন আগে এইখানে কয়েকজন গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে। তাদের আত্মা এখনও গাছেই থাকে। কেউ কেউ নাকি দেখেছে। একজনকে নাকি তারা মেরেও ফেলেছে। এখানকার মানুষ গুলো এই কথাগুলা গভীরভাবে বিশ্বাস করে। তাই সন্ধ্যে হয়ে গেলে এই রাস্তা কেউ মাড়ায় না। যদি বিশেষ প্রয়োজন থাকে, তবে আগুন হাতে কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা যাওয়া করে।
খোকার মা একবার আকাশের দিকে আর একবার খোকার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলো "কতদিন পরে এসেছে মানুষগুলো, কি যে করি !"
  সেই সময়, পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধ মহিলা খোকার মা কে উদ্দেশ্য করে বলল-" কি হলো রে ?"
- আর বলো না মেজো মা। অনেকদিন পর আমার ভাবিরা এসেছে বেড়াতে। ঘরে কিছু নেই তাই খোকাকে বলছিলাম দুটো ডিমে এনে দিতে। আবার সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে!
- তোরই বা কি আক্কেল, ভরা সাঁঝে....। খোকাকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দে আমার ঘরে দুটো ডিম আছে । নিয়ে আসুক।
সন্ধ্যা গড়িয়ে এখন রাত। খোকার মামির সঙ্গে তার এক ভাইপো এসেছে। নাম মমিন। খোকার বয়সি। তার সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে। সকলে বসে যখন গল্প করছে। ওরা ঘরের আলাদা এক কোণে বসে খেলা করছে।
সেই সময়, দরজায় টোকা দিয়ে -"রহমত ভাই বাড়িতে আছো?" বলে ডাকলো।
-" আব্বা , কে যেন আপনাকে ডাকছে।" খোকার মা সেই ডাক শুনে বলল।
রহমত শেখ দরজা খুলে-" আরে শ্যামলদা। আসুন আসুন। অনেকদিন পর এলেন।"
- তোমরা সব কেমন আছো? আর সেই ছোট্ট ভাইটা আমার?
-হ্যাঁ হ্যাঁ সব ভালই আছে। আপনার শরীর কেমন এখন শ্যামলদা?
দাওয়াই পাতা চৌকির উপরে বসলো ওরা।
-- তোমার শ্যামল কাকাকে একটু চা করে দাও গো বউমা।
চায়ের কাপের শ্যামল মন্ডল চুম্বক দিয়ে বলল- "দেশের যা অবস্থা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড় কঠিন।"
-তাইতো শ্যামলদা। চাষাবাদে লাভের মুখ তো দেখাই যায় না। কোন রকমে বেঁচে থাকা দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে। চাষীদের কে দেখার কেউ নেই গো দাদা।
- দেখতে বাধ্য না করলে কেউ কাউকে দেখে না গো। এই যে দেখো আমাদের পশ্চিম মাঠের খালটাই যদি সময়মতো মাছধরা খাটান ভেঙে দেয়  তবে বর্ষার ধান চাষীদের ঘরে ওঠে আবার চৈত্র মাসের ফসল বোনা সঠিক সময় হয়।
- এ তো দীর্ঘ দিনের বড় সমস্যা দাদা। যার যখন ধান নষ্ট হয় সে তখন নিজে নিজের গা কামড়ায় । এটুকুই। সমাধান কিছু হয়না।
- এবার একটু সকলে একত্রিত হয়ে একটা প্রতিবাদ সংগঠিত করার চেষ্টা করলে হয়না? 
রহমত শেখ এবার কেমন একটু বিমর্ষ হয়ে বলল -" তা কি করে হবে? সরকারি নানা কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভ একদিকে দেখিয়ে রেখেছে। আর একদিকে কখন আমাদের নাগরিকত্ব চলে যাবে, তার ভয়। ভয় দেখে রেখেছে শ্যামলদা। আমাদেরকে ঘিরে শুধু ভয়।"
শ্যামল মন্ডল ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- " এ বিশ্বাসদের তেঁতুল গাছের ভূতের ভয় এর মতো ভয় দেখিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের টুকরো টুকরো করে রাখা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয় ।"
-"আমাদের মত দিন আনা দিন খাওয়া মূর্খ মানুষগুলা এত কিছু বোঝার সময় সুযোগ কোথায়?"
-" আর এটা ওদের শক্তির উৎস।"
-"না শ্যামলদা আপনি যাই বলেন ওই খাল সব নেতাদের কেনা থাকে। তাদের বিরুদ্ধে লড়ে বেঁচে থাকার সামান্য সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইবে না কেউ।"
- "একে কি বেঁচে থাকা বলো রহমত?"
- "দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকলেই হলো। এর বাইরে আর আমাদের মত মানুষ আর কিছু ভাবতে পারে?"
- "তবে রহমত অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায় বাড়তেই থাকে। আর প্রতিবাদটা কাউকে-না-কাউকে প্রথম শুরু করতে হয়।"
রহমত শেখ আর পাঁচজনের মতো শ্যামল মন্ডল এর সঙ্গে সহমত হতে না পারলেও তার কথাকে অস্বীকার করতে পারল না।
  পরেরদিন সন্ধ্যে। খোকাকে একাই বাড়িতে ঢুকতে দেখে খোকার মা বলল- "মমিন কোথায়?"
- "মমিন তো আমার সাথে খেলতে যাইনি। ও দুপুরে ঘুমাচ্ছিল বলে তুমিই তো আমাকে ডাকতে মানা করলে।"
- "তাহলে কোথায় গেল।" বলে খোকার মা খোকাকে নিয়ে পাড়ায় খুঁজতে বেরোল। কোথাও পেল না। রাস্তার রহমত শেখ কে দেখতে পেয়ে, খোকার মা মমিনকে না পাওয়ার খবরটা তাকে বলল।
- আমাদের পাড়ায় কোথাও পেলে না? 
- না।
- "তবে ওপাড়ায় চলে যায় নি তো?" রহমত শেখ কেমন ভয়ার্ত গলায় বিড় বিড় করল।
তারপর, পাড়ার একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওপাড়ায় যাবে বলে একগোছা পাটকাঠির আগুন ধরাতে, আগুনের আলোয় ওরা দেখতে পেল , মমিন বেলুন বাধা একটা সুতোর মাথা ধরে আসছে। ওই বাগানে রাস্তা দিয়ে।  খোকার মা ছুটে গিয়ে মমিনের দু গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কোথায় গিয়েছিলে বাবা তুমি?"
- বিকেলে ঘুম থেকে উঠে খোকাকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওই পাড়ায় গিয়েছিলাম। মমিন ঘাড় ঘুরিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে পাশের পাড়াটাকে নির্দেশ করে এমনি করে বলতে থাকলো।-"  দেখি জাদু খেলা হচ্ছে, তা দেখতে দেখতে আমার সন্ধ্যা হয়ে গেল। তারপর আসার সময় দেখলাম ওই তেঁতুল গাছ টায় কত জোনাকি পোকা খুব ভাল লাগছিল তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে গিয়ে আরো দেরী হয়ে গেল।"
এবার রহমত শেখ চোখ দুটো  বড় বড় করে আতঙ্কগ্রস্থ গলায় বলল -ওই তেঁতুল গাছে আর কিছু দেখনি?
-না।
-এবার খোকার মা কেমন উদভ্রান্তের মতো বলল আরে বোকা ওই গাছটাই জিন থাকে আত্মা থাকে ওখানে মানুষ সন্ধ্যার পর গেলে মেরে ফেলে।
খোকার মায়ের মুখে এই কথা শুনতেই মমিন কেমন  অচৈতন্যের মত খোকার মায়ের গায়ে এলিয়ে পড়ল।   বেলুনটা হাত থেকে খুলে আকাশের দিকে উড়ে গেল। আকাশের অন্ধকারে  মিলিয়ে গেল।
রহমত শেখ অন্ধকারে বেলুন মিলিয়ে যাওয়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল।

1 Comments

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post