ছয়শো বছর ভারতের ইতিহাস হিন্দু ও মুসলমানদের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস নয়।।

     # ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কুতুবুদ্দিন আইবকের রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন অবধি এই ছয়শো বছর ভারতের ইতিহাস হিন্দু ও মুসলমানদের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস নয়।।

***********************************************************************************

from abdur Rouf


     নবম শতাব্দীতে মোহাম্মদ বিণ কাসিম যেদিন প্রথম সিন্ধুর উপকূলে অবতরণ করেন, সেদিন থেকেই ভারতে মুসলমান আক্রমণের সূত্রপাত। এই পরম্পরার পরিসমাপ্তি ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আহাম্মদ শাহ আবদালির সর্বশেষ আক্রমণে।

    এই আক্রমনগুলোর কোন একটিও কোন ধর্ম উন্মাদ মুসলমানের করা ইসলাম প্রসারের উদ্দেশে জেহাদ হিসাবে পরিচালিত হয়েছিল কিনা  সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর সব আক্রমণের মত এগুলোর পেছনেও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার চেয়ে পার্থিব ও বাস্তব স্বার্থবুদ্ধির প্রভাবই বেশি দেখা গিয়েছিল। 

    আদি আক্রমনগুলোর সময়ে এ দেশের তথাকথিত হিন্দুরাই এদেশের একমাত্র অধিবাসী ছিল বলে সেই আক্রমণ প্রতিরোধে তারাই এগিয়ে এসেছিল। সেই আক্রমণে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আকার নিয়েছিল।

   কিন্তু সেই আদি সময় থেকে ওইসব আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্য পোষণ করতেন।

    একাদশ শতাব্দীতে সাহাবুদ্দীন ঘোরীর সময় থেকে বহিরাগত প্রত্যেক মুসলমান আক্রমণকারী, তিনি তাতার, তুর্কী, মোগল অথবা আফগান যে কোন জাতিরই হোক না কেন, প্রথমে ভারতের অংশবিশেষের উপর নিজের প্রভুত্ব কায়েম করেছেন। রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীর রাজধানী থেকে সমগ্র রাজ্য শাসন করা অসম্ভব না হলেও, যেমন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিল, তেমনি দূরবর্তী প্রদেশগুলোর জন্য শাসনকর্তা নিয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করেছিলেন। 

     ওই নিযুক্ত শাসনকর্তারা কেন্দ্রের শাসনযন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, যে প্রদেশে তারা নিযুক্ত, তৎপরতার সঙ্গে সেই প্রদেশের স্বাধীন রাজা রূপে নিজেদের ঘোষণা করেছেন।

      সুতরাং দেখা যাচ্ছে সুদীর্ঘ মুসলমান শাসনকালে যে সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহ ঘটেছে তাকে দু ভাগে ভাগ করা যায়।

      প্রথমতঃ মুসলিম অধিকারের সীমা সম্প্রসারণের যুদ্ধ, যা পরিচালিত হয়েছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে।

       দ্বিতীয়তঃ কিছুদিন যেতে না যেতেই যে দ্বিতীয় প্রকারের সংগ্রাম বা অভিযান শুরু হয়েছিল তা হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। হয়েছিল মুসলমান নৃপতি, অথবা সেইসব বিদ্রোহী শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে, যারা নিজের নিজের শাসনাধীন অঞ্চলে নিজেদেরকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এই সমস্ত সংগ্রামে হিন্দুরা উভয় পক্ষে থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

      ঘোরীদের পর থেকে যে সব মুসলমান আক্রমণকারী উত্তর পশ্চিম সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে, বস্তুত তাদেরকে মুসলমান রাজ্যই আক্রমণ করতে হয়েছে।

      তৈমুর ও নাদিরশাহের আক্রমণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি, হয়েছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং তা প্রতিরোধ করেছিল মুসলমানেরাই।

      পানিপথের যুদ্ধে যাকে পরাজিত করে বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন মুসলমান দিল্লীর অধিপতি ইব্রাহিম লোদী। 

      মেবারের রানা সঙ্গ বাবরের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেন, তাতে তিনি যে কেবল রাজপুতদের সাহায্য পেয়েছিলেন তা নয়, মেওয়াতের হাসান খান এবং সিকিন্দার লোদীর এক পুত্র মোহাম্মদ লোদীও সেই যুদ্ধে তার পক্ষে ছিলেন। ১৫২৭ সালে কানোয়ার যুদ্ধে হিন্দু মুসলমানের এই মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করবার পর ভারতবর্ষে তাহার সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

     বাবরের পুত্র হুমায়ূন মুসলমান পাঠান শেরশাহের কাছে পরাজিত হবার পর কিছুদিনের জন্য রাজ্য তার হাত থেকে চলে যায়। শের শাহের মৃত্যুর পরে তা আবার জয় করা হলে আকবর মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করেন। আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মুসলমান সম্রাটদের বেশিরভাগ সময় ও শক্তি ব্যয়িত হয়েছিল স্বাধীন মুসলমান ও বিদ্রোহী মুসলমান শাসনকর্তাদের দমন ও দলিত করার চেষ্টায়।

     আওরঙ্গজেবকে যে গোলকোণ্ডা ও বিজাপুর রাজ্য জয় করবার জন্য দীর্ঘদিন দাক্ষিণাত্যে থাকতে হয় এবং অবশেষে সেখানেই তিনি মারা যান, একথা তো সবাই জানে। এই সমস্ত অভিযানের অধিকাংশই পরিচালিত হয় আকবরের সময়ে মানসিংহ ও ভগবান দাস এবং আওরঙ্গজেবের সময়ে জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহের মতো হিন্দু সেনাপতিদের নেতৃত্বাধীনে। এই সকল অভিযান যাদের বিরুদ্ধে হতো তারা যে সব সময় মুসলমান নরপতি হতেন তা নয়, তখনও স্থানে স্থানে হিন্দু রাজারাও এদের লক্ষ্যবস্তু হতেন।

      সুতরাং দেখা যাচ্ছে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কুতুবুদ্দিন আইবকের রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন অবধি এই ছয়শো বছর ভারতের ইতিহাস হিন্দু ও মুসলমানদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস নয়। বরঞ্চ এই সময়ের মধ্যে হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষ অপেক্ষা মুসলমান ও মুসলমানের মধ্যে সংঘটিত সংগ্রামের সংখ্যা বহুগুণ বেশী। দীর্ঘ ছয়শো বছর ধরে মুসলমান শাসকগণ হিন্দুদের বিরুদ্ধেই অবিশ্রাম সংগ্রাম করেছেন, হিন্দুদের নিগৃহীত ও নিপীড়িত করেছেন এবং তাহার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততার সঞ্চার হয়েছে, এই ধারণা যারা পোষণ করেন, তারা ঐতিহাসিকভাবে একদেশদর্শী।

      যে সব মুসলমান বিজেতা রূপে এদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেন তাদের সংখ্যা অমুসলমান জনসাধারণের সাথে সংখ্যাগত তুলনায় নিতান্ত নগন্য। আজকের এই ভারতীয় মুসলিম সংহতির বিরাটতর অংশ গঠন করেছেন সেসব হিন্দুরা যারা নিজেরাই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, নয় ধর্মান্তরিত হিন্দুদের সন্তান সন্ততি।

    সামরিক কার্যকলাপের মধ্যেই যদি এতখানি সৌহার্দ, সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরতা থেকে থাকে, তবে অসামরিক শাসনকার্য পরিচালনায় ও জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাপনে তা যে আরও বেশী পরিমাণে ছিল তা আসা করাটা যুক্তিসঙ্গত এবং ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রতিষ্ঠিত।  প্রয়োজন বশেই তারা রাজকাজে হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। গজনীর মামুদের বাহিনীতে বহু হিন্দু সৈন্যদল ছিল, এবং তার হিন্দু সেনাপতি তিলক তার মুসলিম সৈন্যাধ্যক্ষ নিয়ালতাগিনের বিদ্রোহ দমন করেন।

     কুতুবউদ্দীন যখন ভারতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ হিন্দু কর্মচারীদেরকে বহাল রাখলেন। কারণ, এইসব কর্মচারীর সাহায্য ছাড়া রাজস্ব আদায় এমনকি সমগ্র শাসন ব্যবস্থা বিশৃংখল হয়ে যাবার আশঙ্কা তিনি অনুভব করলেন। মুসলমানগণ ভারতের বাইরের থেকে কারিগর, কেরানী ও হিসাবরক্ষক সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি। হিন্দু মিস্ত্রিগণই পুরানো কলা কৌশলের সঙ্গে নতুনের সমন্বয় করে তাদের গৃহ নির্মাণ করেছিল। তাদের মুদ্রা প্রস্তুত করত হিন্দু স্বর্ণকার, হিসাব রক্ষা করত হিন্দু কেরানী। ব্যবহার শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ হিন্দু আইন ঘটিত ব্যাপারে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। হিন্দু জ্যোতিষগণ করণীয় ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতেন। 

   প্রথম ইব্রাহিম আদিল শাহের শাসনকালের (১৫৩৪ - ১৫৫৭) অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পারসীর পরিবর্তে হিন্দি ভাষায় হিসাব রক্ষা করবার প্রথা প্রবর্তন। এই কাজের জন্য যে সব ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হয়েছিলেন খুব তারাতারি তারা রাজসরকারে প্রভূত প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন।

   সুলতান মহম্মদ তুঘলকের অধীনে বহু হিন্দু কাজ করতেন। তার রাজস্ব বিভাগের অন্যতম প্রধান কর্মচারী ছিলেন রতন নামীয় জনৈক হিন্দু। 

   আকবরের রাজস্ব সচিব রাজা টোডরমল্ল তৎকালীন শাসনব্যবস্থার সুদূর প্রসারী পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। সর্বোচ্চ রাজপুরুষদের মধ্যে তিনি অন্যতম বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের রাজস্ব সচিবও ছিলেন হিন্দু রঘুনাথ।

✍️গৌতম  মুখার্জী

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post