মনীষীদের সৃষ্ট বঙ্গসংস্কৃতি বিপন্ন

বিপন্ন বঙ্গসংস্কৃতি
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
১৬ আগস্ট ২০২২
ছেলেটির পদবী পাল। নামটি উহ্য থাক। সে কান্দির নিকটবর্তী পুরন্দরপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ইলেভেনে পড়ে। হাতে একগুচ্ছ ময়ূরপুচ্ছ নিয়ে সারা রাস্তা বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে এল। বহরমপুরের রামেন্দ্রসুন্দর সেতু ওরফে রাধারঘাটের ব্রিজ পেরিয়ে সে যখন বন্ধুদের সাথে বাস থেকে নামল তখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ছটার কাছাকাছি। বন্ধুদের মধ্যে ছেলে-মেয়ে সবই আছে। তাদের হাতে হাতে সুসজ্জিত বাঁক সহ প্লাস্টিকের ছোট ছোট কলসি। বাসের ছাদ ভর্তি হয়ে যারা এল তাদের কাছে একটা অস্বাভাবিক লম্বা বাঁক, যা জল ভরার পর একজনের কাঁধে থাকলেও সামনে-পিছনে দুজনকে ধরতে হবে ঝুল সামলানোর জন্য। সেই বাঁকটির অঙ্গসজ্জার জন্যই একগুচ্ছ ময়ূরপুচ্ছ। এরা কলসিতে গঙ্গাজল ভরার পর সারারাত ধরে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কান্দির নিকটবর্তী এক শিব মন্দিরে পৌঁছাবে ভোরবেলায়। 'বাবার মাথায়' জল ঢেলে তবে শান্তি! বহরমপুর থেকে কান্দির দূরত্ব সাড়ে ৩৩ কিলোমিটার। দুপুরে যাওয়ার সময় ঘড়ি দেখিনি, ফেরার সময় বাসে সময় লাগলো পাক্কা দেড় ঘন্টা। নির্মীয়মান রণগ্রাম ব্রিজ হেঁটে পার হওয়ার জন্য মিনিট দশেক সময় বাড়তি লাগছে। যাওয়া এবং আসার পথে একই দৃশ্য দেখা গেল। কান্দির দিক থেকে বাসে, ট্রেকারে, ছোট-বড় লরিতে গাদাগাদি করে বহরমপুরে জল নিতে আসছেন ভক্তরা। অনেকে আসছেন পায়ে হেঁটেও। ফেরার সময় সবাই ফিরছেন খালিপায়ে হেঁটে। ঝাঁকে ঝাঁকে যারা হাঁটছেন তাদের পরনে বিভিন্ন রঙের দলগত ইউনিফর্ম। লাল, সাদা, কালো, গেরুয়া। মেয়েদের ম্যাচিং শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ। কিছু দূরে দূরে পথের ধারে 'পুণ্যার্থীদের' সেবার জন্য সুসজ্জিত শিবির তৈরি করা হয়েছে। পাতা রয়েছে প্রচুর চেয়ার। চেয়ার টেবিলে বসে একদিকে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম চলছে, অন্যদিকে বড় বড় হাঁড়ি-কড়াইতে ক্রমাগত রান্না হচ্ছে খিচুড়ি। মাইকে তারস্বরে গান বাজছে, কোথাও বা উৎকট ডিজের আওয়াজ। শিবিরের প্যান্ডেলের গায়ে ফ্লেক্সে ঝোলানো রয়েছে নেতা-নেত্রী-বিধায়কের ছবি। একেকটি প্যান্ডেলে কান্দির তৃণমূল বিধায়ক অপূর্ব সরকারের তিন-চারটি ছবিও শোভা পাচ্ছে।
পুণ্যার্থীদের মধ্যে তরুণ-তরুণীরাই সংখ্যায় বেশি। রয়েছে বেশ কিছু স্কুল পড়ুয়া বালক-বালিকাও। কোন কোন দলের সাথে রয়েছে জাতীয় পতাকাও। মাননীয় মোদী মহাশয় ঘোষিত 'অমৃত মহোৎসব'-এর আগের দিন বলেই জাতীয় পতাকা বেরিয়েছে কিনা জানি না! মুহুর্মুহু উঠছে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। এর আগে শিব-ভক্তদের মুখে শোনা যেত 'জয় বাবা ভোলানাথ', 'হর হর মহাদেব', 'ভোলেবাবা পার লাগাও' ইত্যাদি স্লোগান। সেই জায়গায় 'জয় শ্রীরাম' কিভাবে ঢুকে
পড়ল?
বাবার মাথায় জল ঢালার এই অভূতপূর্ব হুজুগের একদিন আগেই, ১২ আগস্ট, ছিল রাখিবন্ধন। প্রাচীন এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ভিন্নতর সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখতেই রাখি বন্ধনের নবতর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। সেই রাখি বন্ধনকে এখন সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষের প্রকরণ করে তুলেছে ধর্মের ধজাধারী রাজনৈতিক দল। অন্যান্য বছরের মতো এবছরও ৭৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত জঙ্গিপুরে রাখি বন্ধনের নামে অস্ত্রমিছিল করেছে শ্যামাপ্রসাদের শিষ্যরা। অস্ত্রকে পরিয়েছে রাখি! হাতে যথারীতি জাতীয় পতাকাও।এদিকে রাজ্যের শাসক দল, আজ ১৬ আগস্ট, রাজ্যজুড়ে পালন করলো 'খেলা হবে দিবস' ! মুখে বলা হচ্ছে, ১৯৮০ সালে খেলা দেখতে গিয়ে নিহতদের স্মরণে এই উদযাপন! কিন্তু দলীয় কর্মীদের চিৎকৃত স্লোগান ও উন্মাদনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দলনেত্রীর সেই 'খেলা হবে' স্লোগানের উত্তেজনা। রাজনীতিকে এইভাবে খেলার স্তরে নামিয়ে আনা কেন? এই কি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের বাংলা? এই কি শহীদ ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, নেতাজির বাংলা? অস্ত্রের ডগায় রাখি পরানোর জয় শ্রীরাম দিবসের ঠিক আগের দিন -- ১১ই আগস্ট -- ছিল এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফাঁসির দড়িতে প্রথম শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গ দিবস। সে কথা আমরা ক'জন খেয়াল রেখেছি!
✍️

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post