রাজনীতির পাশাখেলায় বাজি দ্রৌপদী

পাশাখেলায় দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। হেরে যাওয়ার পর দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন তার বস্ত্রহরণ করে। প্রকাশ্য রাজসভায় নারীর সেই চরম অবমাননার নির্বাক দর্শক ছিলেন তথাকথিত গুণীজনেরা। মহাভারতের স্বঘোষিত সোল অথরিটি যারা, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আজ আবার খুঁজেপেতে আরেক দ্রৌপদীকে আবিষ্কার করেছেন রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর জন্য। এই দ্রৌপদী আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত এক নারী। আদিবাসীদের ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ পৃথক, যা রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের সংকীর্ণতর খাপে কিছুতেই আঁটে না। আঁটে না বলেই মহাকাব্যে রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়, যা আসলে আর্য-অনার্যের যুদ্ধ। এদেশের আদি বাসিন্দা অর্থাৎ আদিবাসীদের পদে পদে পদদলিত করাই বহিরাগত আর্যদের পবিত্রতম সামাজ-রাজনৈতিক কর্ম ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথার ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত শূদ্র অর্থাৎ দলিত শ্রেনীকে অবদমিত করে রাখাও তাদের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধুনিক উত্তরসূরীরাই আজ আদিবাসী নারী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত করে নিজেদের গা থেকে দলিত ও আদিবাসী বিরোধী তকমা খুলে ফেলতে চাইছেন।

৯ জুন দুপুরে এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোন খবর নেই, তবে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে মোদি মন্ত্রিসভার একমাত্র মুসলিম মুখ মুক্তার আব্বাস নকভিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার জন্যই। তাহলে চিল যেমন 'সমস্ত দিনের শেষে ডানার রোদের গন্ধ মুছে ফেলে', তেমনি করে সংঘ পরিবারও কি মুসলিম ও দলিত বিরোধী তকমা মুছে ফেলতে চাইছে? মুসলিম বিদ্বেষই যাদের রাজনীতির চালিকাশক্তি তাদের পক্ষে মুসলিম বিরোধী তকমা মুছে ফেলা সম্ভবও নয়, প্রয়োজনও নেই। দেশের মাত্র ১৪ শতাংশ -- সংখ্যাগতভাবে ১৭ কোটি মাত্র -- মুসলিমকে তোপের মুখে দাঁড় করিয়ে বাকি হিন্দুদের ভোট যদি সংহত করা যায় তাহলেই তো হিন্দুরাষ্ট্র সফল। বৈদিক যুগের আগে থেকেই যারা এদেশের আদি বাসিন্দা -- যারা আদতে হিন্দুই নন -- তাদের এবং চিরদিন লাথিঝাঁটা খেতে অভ্যস্ত শূদ্র শ্রেণীভুক্ত দলিতরা যদি ভোটের বাজারে অন্তত হিন্দু হয়ে উঠতে পারেন তাহলে তো কেল্লাফতে। তা অন্যকথায় আসার আগে সাম্প্রতিককালে সর্বজ্ঞাত এবং স্বল্পজ্ঞাত কয়েকটি দলিত দমনের ঘটনা উল্লেখ করা যাক।

১) ২০১৬ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। ঘটনাস্থল নরেন্দ্র মোদির খাসতালুক গুজরাটের এক ছোট্ট শহর উনা। সিংহের হানায় নিহত হয় চারটি গরু। সেই গরুর চামড়া ছড়াতে যায় পেশায় চর্মকার চার যুবক। সেই অপরাধে উচ্চবর্ণীয় গোরক্ষক বাহিনী সেই দলিত যুবকদের পিঠের চামড়া তুলে নেয় আক্ষরিক অর্থেই। গাড়ির সাথে বেঁধে লাঠি ও রড দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। ঘটনাটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যথারীতি মুখে কলুপ এঁটেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং 'দলিত নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি' বলে প্রশাসনের দায় এড়িয়েছিলেন। অতঃপর অনগ্রসর মন্ত্রী ও সাংসদদের দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করিয়ে গুজরাট সরকারের প্রশস্তি গাওয়ানো হয়। ঠিক তার পরের বছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আনন্দ জেলার কাসর গ্রামে অনুরূপ ঘটনা ঘটে। মরা গরুর ছাল ছাড়ানোর অপরাধে দলিত সম্প্রদায়ের মা মনিবেন(৪৫) ও ছেলে শৈলেশ রোহিতকে কুড়ি মিনিট ধরে মারধর করে ক্ষত্রিয়রা।

২) এবার আসুন যোগীরাজের রামরাজ্য উত্তর প্রদেশে। দিনটা ছিল ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। স্থান হাথরস। এই নামটি শুনলেই ঘটনাটি অনেকের মনে পড়ার কথা। বছর বিশেকের এক দরিদ্র দলিত তরুণী ক্ষেতে কাজ করছিলেন। উচ্চবর্ণের চারজন যুবক তাকে গণধর্ষণ করে। দু'সপ্তাহ দিল্লির হাসপাতালে বাঁচার লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় বেচারী তরুণী। তরুণীর পরিবারের সদস্যরা থানায় গেলে অভিযোগ গ্রহণের পরিবর্তে তাদেরকেই শাসানি দেওয়া হয়। এমনকি তরুণীর মৃতদেহ পরিবারের হাতে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে গোপনে দাহ করে দেয় পুলিশই। উচ্চবর্ণের প্রভাবশালীদের আড়াল করাই যেখানে পুলিশি পবিত্র কর্তব্য সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তরুণীকে 'ধর্ষণের কোন প্রমাণ মেলেনি'!
৩) এটিও যোগীরাজ্যের একটি ঘটনা। গত এপ্রিল মাসে আড়াই মিনিটের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, বাইকের উপরে বেশ বশের ভঙ্গিতে বসে আছে এক যুবক। আরেক ভীত-সন্ত্রস্ত হীনমন্য কিশোর নিজের কান ধরে আক্ষরিক অর্থেই পা চাটছেন বাইক-আরোহীর। পা চাটতে চাটতে সকাতরে 'বশ'কে 'ঠাকুর' বলে সম্বোধন করছেন। কিশোরটি দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার মা ক্ষেতমজুর। বাইক আরোহী উচ্চবর্ণের সেই যুবকদের জমিতে কাজ করেন। কাজের মজুরি চাওয়ার অপরাধেই তার ছেলের এই হেনস্থা।
হ্যাঁ, হিন্দুত্বের নতুন পরীক্ষাগার উত্তরপ্রদেশে এসব এখন জলভাত। সেখানে এখনো উচ্চবর্ণের পাড়া দিয়ে দলিতদের বিয়ের বরযাত্রী যাওয়ার হুকুম নেই!

৪) ২০১৬ সালে সারা দেশে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল একটি আত্মহত্যার ঘটনা। হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গবেষক দলিত সম্প্রদায়ের রোহিত ভেমুলার ওপর মাসের পর মাস মানসিক নির্যাতন চালিয়ে কার্যত তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বিচারাধীন অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোদ উপাচার্য থেকে শুরু করে মোদি সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী বান্দারু দত্রাত্রেয় এবং বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপির এক নেতা।

দলিত দমনের উদাহরণ অজস্র। কত আর লেখা যায়! শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই সারা দেশে চল্লিশ হাজারের বেশি দলিত বিরোধী অপরাধ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। এ তো গেল দলিতদের প্রতি বর্ণহিন্দুদের সামাজিক নিপীড়নের কথা। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার ঘটনাও নেহাত কম নয়। ২০০৬ সালের সংশোধিত অরণ্যের অধিকার আইনের পথ ধরে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী পরিবারের মাথার উপরে উচ্ছেদের নোটিশ ঝুলছে এই মুহূর্তে। বনবাসী আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য গ্রামসভার যেটুকু নিয়মতান্ত্রিক অনুমোদন লাগতো সেটাও সম্প্রতি বাতিল করে দিয়েছেন মোদি সরকার।

এই অবস্থায় এক আদিবাসী নারীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে কোন বার্তা দিতে চাইছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা? ইনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আদিবাসীদের 'আচ্ছে দিন' আসবে কি? বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ভারতের বর্ণব্যবস্থায় নিম্নবর্গীয় কোলি (Koli) সম্প্রদায়ভুক্ত। এই সম্প্রদায় উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবী আবার কোথাও কোথাও কৃষিজীবী। তিনি নিজেও এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁর পাঁচ বছরের রাষ্ট্রপতিত্বে এদেশের কোলি সম্প্রদায়ভুক্ত চির অবহেলিত মানুষদের জীবনযাত্রার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেছে কি? তাঁর আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাঙালি রাষ্ট্রপতি বলে কত জনের কত আদিখ্যেতা। শেষ পর্যন্ত বাঙালির কোন উপকারটি হয়েছে? প্রণব বাবুর আগে দেশের প্রথম এবং একমাত্র নারী রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রতিভা পাতিল। দেশে নারী নির্যাতন কি কিছুমাত্র কমেছিল সেই সময়? এই যে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী, তা সত্ত্বেও নারী নির্যাতনে এই রাজ্য শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাচ্ছে কি করে? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলেছেন, দ্রৌপদী মূর্মুকে প্রার্থী করা হবে তা আগে জানলে তিনি তাঁকেই সমর্থন করতেন! এই উক্তি নারী এবং আদিবাসী প্রেমের পরাকাষ্ঠা, নাকি বিজেপি প্রেমের? এই কথার মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো কংগ্রেসকে বুঝিয়ে দিলেন -- "আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না।" অর্থাৎ বিজেপির শক্তপোক্ত নৌকোতেই সওয়ার হতেন! রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রঙ্গ নানারকম। সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্রমশ কোণঠাসা 'সংসদীয় বামেরা' আবার বিজেপি ত্যাগী তৃণমূল প্রার্থী যশবন্ত সিংহকেই সমর্থন করেছেন! তাদের অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি। প্রার্থী যশবন্ত সিংহ নিজেই বলেছেন, আগে বিরোধী প্রার্থীর নাম জানলে তিনি দাঁড়াতেন না -- আর তাকেই সিপিএম আঁকড়ে ধরে বিরোধী ঐক্যে শান দিচ্ছে! বেসুরো আলিমুদ্দিনকে পর্যন্ত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দিয়েছেন ইয়েচুরি। বলেছেন, এটা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই। জ্যোতি বসু স্মরণে এক সভায় ইয়েচুরি একথা বললেও, জ্যোতি বসু কেন অটলজীর হাত ধরেছিলেন, সে কথা বলেননি। তবে শেষ বিচারে বিজেপির মুন্সিয়ানা মানতেই হবে। ঠিক এক বছর আগে আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদী কর্মী সর্বত্যাগী অশীতিপর ফাদার স্ট্যান্ স্বামীকে মিথ্যা মামলায় কালা কানুনে গ্রেফতার করে যারা কার্যত হত্যা করল, সেই তারাই যখন আদিবাসী প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করতে চান তখন একাধারে হাসির উদ্রেক হয়, আবার ক্ষোভ ও ধিক্কারও জন্মায়। মনে পড়ে যায় কাজী নজরুলের গানের সেই বিখ্যাত লাইন--
"তোরা ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া/জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া।"
✍️
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
১১ জুন ২০২২
(লেখাটি মুর্শিদাবাদ জেলার শীর্ষস্থানীয় সংবাদ-সাহিত্য সাপ্তাহিক ঝড় পত্রিকায় আজকেই প্রকাশিত হয়েছে।)

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post