একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত গাইড এবং অর্বাচীন সাংবাদিক ইতিহাস বিকৃতির নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করে চলেছেন।


ইতিহাস প্রসিদ্ধ জেলা মুর্শিদাবাদ। স্বাভাবিকভাবেই এই জেলা নিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মধ্যে রয়েছে প্রবল কৌতূহল। আর এই সুযোগে একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত গাইড এবং অর্বাচীন সাংবাদিক ইতিহাস বিকৃতির নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করে চলেছেন।
সংগৃহীত 

গত ২১ অক্টোবর কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে এসেছিলেন ১৮ জন বিদেশি পর্যটকের একটি দল। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের এই পর্যটকেরা ইস্ট হিমালয়ান ট্যুরে বেরিয়েছেন বিভিন্ন মডেলের ভিন্টেজ গাড়িতে করে। এই সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে স্থানীয় একটি চ্যানেলের এক তরুণ সাংবাদিক গলায় প্রবল উত্তেজনা চাপিয়ে অবলীলায় বলে দিলেন, "হিউয়েন সাং থেকে রবীন্দ্রনাথ -- মুর্শিদাবাদের এই কাশিমবাজারের রাজবাড়িতে এহেন পর্যটক নেই যারা আসেননি!" হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ কাশিমবাজার রাজবাড়িতে এসেছিলেন এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু সেটা 'বড় রাজবাড়ি'। আর যেখান থেকে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো অর্থাৎ পর্যটকেরা যে রাজবাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন সেটি হল 'ছোট রাজবাড়ি'।
ছোট রাজবাড়ির পূর্বপুরুষ শ্রীকর চট্টোপাধ্যায় বর্ধমানের পাত্রসায়র থেকে মুর্শিদাবাদের প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র ভগবানগোলায় আসেন। তাঁর নিম্নতন অষ্টম পুরুষের জয়গোপাল চট্টোপাধ্যায় মুঘল আমলে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে 'রায়' পদবী প্রাপ্ত হন। এই জয়গোপালের নিম্নতন চতুর্থ পুরুষ অযোধ্যারামের আমল থেকে শুরু হয় কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির ইতিহাস। বাড়িটির সামনে নির্মাণকাল পরিষ্কার ভাবে লেখা রয়েছে - ১৭৪০ সাল অর্থাৎ সেটা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী। আর হিউয়েনসাং ভারতে এসেছিলেন সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে। তখন কাশিমবাজারের রাজাই বা কোথায়, রাজবাড়িই বা কোথায়!
সংগৃহীত 

বড় রাজবাড়ির পূর্বপুরুষ কালিন্দীচরণ নন্দী কাশিমবাজারের শ্রীপুর এলাকায় এসেছিলেন বর্ধমান জেলার শিজলা গ্রাম থেকে। এসেছিলেন রেশম ব্যবসা করবেন বলে। তাঁর পৌত্র রাধাকৃষ্ণ নন্দী রেশম ব্যবসার পাশাপাশি একটি মুদি দোকান খোলেন। রাধাকৃষ্ণের পুত্র কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সাথে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে কর্মসূত্রে পরিচয় ঘটে ওয়ারেন হেস্টিংসের। কৃষ্ণকান্ত নন্দী ওরফে কান্তবাবুর পুত্র লোকনাথ নন্দী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে রাজা উপাধি পান। লোকনাথের পুত্র হরিনাথ (১৮০৩ - ১৮৩২)। এই হরিনাথের পুত্র কৃষ্ণনাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৮২২ সালে। প্রয়াত হন মাত্র ২২ বছর বয়সে। ডেভিড হেয়ারের আদর্শে প্রাণিত কৃষ্ণনাথ আত্মঘাতী হওয়ার আগে সমস্ত সম্পত্তি শিক্ষা বিস্তারের কাজে দান করে যান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উইলিয়াম ল্যামব্রিকের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন 'মুর্শিদাবাদ নিউজ', ১৮ বছর বয়সে গুরুদয়াল চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশ করেন অবিভক্ত বাংলার মফঃস্বল এলাকার প্রথম বাংলা পত্রিকা 'মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী'। স্বল্পকালীন জীবনে শিক্ষাচেতনা ও সমাজ হিতৈষণার যে স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তা বিস্ময়কর। তিনি উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র। তাঁর অপূরিত ইচ্ছা পূরণ করতেই সুযোগ্য সহধর্মিনী রানি স্বর্ণময়ী ১৮৫৩ সালে স্থাপন করেন কৃষ্ণনাথ কলেজ -- যেটি বর্তমান রাজ্য সরকারের অবিমৃশ্যকারিতায় আইনত অস্তিত্বহীন।

রাজা কৃষ্ণনাথের স্মৃতিধন্য কাশিমবাজার বড় রাজবাড়িতে ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন দানবীর মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। নিঃসন্তান কৃষ্ণনাথের ভাগিনেয় মণীন্দ্রচন্দ্র ছিলেন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। মণীন্দ্রচন্দ্রের পৌত্র নবতিপর সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দী এখন কলকাতায় থাকেন। ঐতিহ্যমন্ডিত কাশিমবাজার রাজবাড়িটি এখন আক্ষরিক অর্থই খন্ডহর।

এই প্রখ্যাত রাজবাড়ির সাথে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির বংশগত এবং কৃষ্টিগত কোনও যোগসূত্র কোন দিনও ছিল না। অথচ এই বাড়িটির সাথে রবীন্দ্রনাথ, এমনকি হিউয়েনসাংয়ের কাল্পনিক স্মৃতি জড়িয়ে ইতিহাসকে একেবারে চটকে দিলেন অতি উৎসাহী তরুণ সাংবাদিক। হায় হায়, কী সব চলছে!!
✍️
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
১ নভেম্বর ২০২২

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post