অমর একুশে ফেব্রুয়ারি
বুকের রক্ত দিয়ে মুখের ভাষা রক্ষা করার সেই ঐতিহাসিক দিন আজ। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের আজকের দিনে রফিক, সালাম, বরকত, জাব্বার, শফিউরের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল ঢাকার রাজপথ। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ঘাতক পাকসেনার হাতে নিহত এই পাঁচ শহীদের দেহ উদ্ধার করা গেলেও আরো বেশ কয়েকজন শহিদকে সেদিন গায়েব করে ফেলা হয়েছিল। উপরোক্ত পাঁচজন শহীদের মধ্যে আবুল বরকত মুর্শিদাবাদের এবং শফিউর রহমান হুগলির বাসিন্দা ছিলেন। প্রথমজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, দ্বিতীয়জন কর্মসূত্রে পূর্বপাকিস্তানে গিয়েছিলেন।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রমাণিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে জাতি (nationality) গঠন এক ভ্রান্ত ধারণা। দেশভাগের অব্যাবহিত পরেই ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য তথা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও লেখার দাবি জানান। দুই পাকিস্তান মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেহেতু বেশি এবং তারা প্রায় সকলেই বাংলা ভাষাভাষী, তাই সরকারি সমস্ত কাজে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এই অপরাধে সেদিন তাঁকে চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়। যদিও করাচির সেই অধিবেশন থেকে ফেরার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিমানবন্দরে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকসেনারা ৮৬ বছর বয়সী সেই মুক্তিযোদ্ধাকে পুত্র সহ তুলে নিয়ে গিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ভাষা আন্দোলনের সলতে পাকানো এই সৈনিক আজ বিস্মৃতপ্রায়। সে কথা অন্য একদিন হবে।
শুধুমাত্র মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে লড়াই করতে করতে নতুন একটি স্বাধীন দেশের আবির্ভাব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে। ২০০০ সাল থেকে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়। আজ বিশ্বের ১৯১টি দেশে উদযাপিত হচ্ছে এই দিনটি।
প্রত্যেকের মাতৃভাষাই তার নিজের কাছে অত্যন্ত আদরণীয়। যখন সেই ভাষার অবমাননা করা হয় তখনই ঘটে বিপত্তি। উর্দু আদতে ভারতীয় ভাষা। কিন্তু তা যখন বাংলাভাষী মানুষের উপরে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাওয়া হলো তখনই গোল বাধলো। এমনিতে ভাষার কোনো জাত-ধর্ম নেই। বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। একইভাবে বিহার,উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কথা বলেন হিন্দি ভাষায়। মুসলমান শাসনামলে ফার্সি ছিল এ দেশের সরকারি ভাষা। সে সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের হিন্দুরাই আরবি-ফারসি চর্চা করেছেন বেশি। রাজা রামমোহন রায়কে তার পরিবার শৈশবেই পাটনায় পাঠিয়েছিলেন ফারসি শেখার জন্য। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ মনীষীরা সংস্কৃত ভাষার সুপন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করার প্রয়োজনে গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি শিখেছিলেন। মৃত ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সংস্কৃতকে। আবার আজ থেকে হাজার বছর আগে আলবেরুনি এদেশের ধর্মশাস্ত্র, শিল্প,সাহিত্য, জ্যোতিষ, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদি আরবি ভাষায় অনুবাদের প্রয়োজনে সংস্কৃত ভাষা নিষ্ঠার সাথে শিখেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাই দারাশিকো ছিলেন সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত।
ভাষা হল ভাবের বাহন। উন্নত ভাবকে বহন করতে পারে উন্নত ভাষা। সেই ভাষাই বেশি উন্নত, যে ভাষা অন্য ভাষার সাথে আদান-প্রদান বেশি করেছে। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের ভাষার সাথে পরিচয় ঘটেছে ইংরেজি ভাষার। আর সেই সব ভাষা থেকে নির্দ্বিধায় বহু শব্দ গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে ইংরেজি ভাষা।
কোনও ভাষাই অপর ভাষার শত্রু নয়। কিন্তু যে ভাষা যুগের নিয়মে কার্যকারিতা হারিয়েছে, ধর্মের নামে তাকে ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টা নিন্দনীয়। আজ আমাদের দেশে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান স্লোগান তুলে সারাদেশে হিন্দির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সরকারি অপচেষ্টা চলছে, অন্যদিকে 'দেবভাষা' বলে সংস্কৃতকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় জাতীয় শিক্ষানীতি - ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে!
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি দিচ্ছে ডাক - যাবতীয় ধর্মীয় মৌলবাদ, সংকীর্ণতা ও কূপমন্ডুকতা নিপাত যাক।
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২