যুদ্ধ কেবল কামান গোলা নিয়েই হয়না

যুদ্ধ কেবল কামান গোলা নিয়েই হয়না......
মুচির মেয়ে
লিখেছেনঃ জিয়ারুল হক

আমার বাড়ির পাশে চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ীতে এক শিক্ষক দম্পতি বাস করতেন। কি কারণে ফ্ল্যাটের ভেতর আগুন লাগলে সারা শরীরে আগুন নিয়ে ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে এসে পাশের এক হাঁটু পঁচা কাদাজলে লুটোপুটি খেয়ে শরীরের আগুন নিবিয়েছিল। দিন রাত হিরোইন খোর ভজা একবার আমার কাছে পঞ্চাশটি টাকার জন্য হাত পেতেছিল।আমি তাকে বলেছিলাম - তোকে পঞ্চাশ নয় একশো টাকা দেব যদি তুই এই পাঁকে একবার নামতে পারিস!সে বলেছিল - শুনো দাদা আমি নেশাখোর বটে,তাবলে হাজার টাকা দিলেও এই পাঁকে নামবো না। নেশার জন্য হেন অপকর্ম করতে যে ভজা পিছপা হয়না সে একশ টাকার লোভেও পাঁকে নামতে রাজী হয়নি, অথচ প্রাণের তাগিদে তাতেই নেমেছিল শিক্ষক দম্পতি।

মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমনি কত দুর্বিসহ সময় এসে উপস্থিত হয় ,হয়ত আগে থেকে স্বয়ং ভগবানও তা কল্পনা করতে পারেন না। অনেকের মুখে শুনি,মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ সবই নাকি উনিই ঠিক করে দেন।কিন্তু বাস্তবে দেখি ভিন্ন। ভালো কাজ করলে তার কৃতিত্ব পান ভগবান অথচ গর্হিত কাজের দায় পড়ে শয়তানের উপর!বড় গোলমাল হয়ে যায়!দুজনের যোগসাজশে এমন ঘটে নাকি শয়তানের বুদ্ধির কাছে ভগবান হেরে যান? কে জানে!
যুদ্ধ কেবল কামান গোলা নিয়েই হয়না
ছবি লেখকের আন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করা


দুই দিকে নদী বেষ্টিত মামুদপুর গ্রামটি। বিশাল গ্রাম। দশ বারোটা ছোট বড় পাড়া নিয়ে এই গ্রামটি। কয়েক হাজার পরিবারের মধ্যে,হিন্দু বলতে গোটা পঞ্চাশ ঘর ঘোষ, গোটা বিশেক ঘর দেবনাথ আর দশ পনেরোটি 'নীচু' দাস সম্প্রদায়ভুক্ত ।বাকি সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের। এমন মিলমিশ গ্রাম খুব কমই আছে। কোনোদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্ট হয়নি।গ্রামের যে কোনো হিন্দু যে কোনো মুসলিম পাড়ায় ভোটে দাঁড়ালেও অনায়াসে জিতে গেছেন। সংখ্যা লঘু, সংখ্যাগুরুর তাস খেলতে হয়নি। এই গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ বিমল দেবনাথ। বাবা মা অনেক কষ্টে বিড়ি বেঁধে তা বিক্রি করে বিমলদের তিন ভাইকে মানুষ করেছিলেন। বাবা অনেকদিন হলো গত হয়েছেন। মা এখনো জীবিত।বড় ভাই যুবক বয়সে কি একটা রোগের যন্ত্রনায় না থাকতে পেরে আত্মহত্যা করেন। মেজভাই পরিমল আর ছোট ভাই বিমল দুজনেই মুদি দোকানী, আলাদা আলাদা দোকান। দুজনেই বিবাহিত। মেজ ভাই আর ছোট ভাই এর বৌ এর মধ্যে দিন রাত কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকত। ছোট বৌ মেজ বৌয়ের চেয়ে বেশি বিত্তশালী পিতার একমাত্র কন্যা ছিল সুতরাং তার অভিমানের মাত্রাটা যেমন একটু বেশি ছিল তেমনি সে বেশিক্ষন ঝগড়া করতে পারত না। আর বড় বৌ ঝগড়া শুরু করলে সকাল থেকে সাঁঝ গড়িয়ে যেত। সংসারের সকল খুঁটিনাটি কাজ শেষ হলেও বকবক শেষ হতো না। শাশুড়ী বলত - বড়ো বৌমা, ছোট তো চুপ করে গেছে,তুমি এবার চুপ করোনা,তুমি তোমার কাজ করো! ঝঙ্কার দিয়ে বড় বৌমা বলত - কেন আমি কি হাতের কাজ বন্ধ রেখেছি নাকি? মুখে কথা হাতে কাজ!আমি কি বড়ো লোকের বেটি যে ছোট বেলা থেকে পায়ের উপর পা তুলে বড় হয়েছি? ছোট বৌ আর সহ্য করতে পারতো না, হঠাত্ ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিত। ঝগড়া ভুলে মেজ জা, শাশুড়ী - দোর খোলো বৌমা, তোমার হাতে ধরি পায়ে পড়ি করে দরজায় ধাক্কা দিত। এক সময় চোখ মুছতে মুছতে হাসি মুখে দরজা খুলে বেরিয়ে আসত ছোট বৌ। এ যেন নিত্য দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ছোট বৌয়ের আরো একটা অভিমান ছিল। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে এক ছেলে এক মেয়ের মা হয়েছে বটে কিন্তু স্বামীর সঙ্গে একদিনের জন্য কোথাও ঘুরতে যাওয়া তো দূরের কথা,দুদণ্ড বসে মনের কথা ও বলার সুযোগ হয়নি। আর বেচারা বিমলও পড়েছে ঘোর বিপাকে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি! সেই ভোর বেলায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে দোকানে যায়, ফেরে রাত এগারোটায়। তারপর গোগ্রাসে গিলে ভোঁস ভোঁস করে ঘুম, পরের দিন আবার ভোরে উঠতে হবে।বিমলের দোকানের পাশে আরও একজন মুদিখানার দোকান দিয়েছে। দিন রাত প্রতিযোগিতা চলে কে কত আগে দোকান খোলে আর কতো রাত পর্যন্ত খোলা রাখতে পারে তাই নিয়ে।একদিন বন্ধ হলেই খদ্দের অন্য দোকানে চলে যাবে!
এমনি একদিন কিছু একটা বিষয় নিয়ে দুই জায়ে ঝগড়া করতে করতে ছোট বৌ ঘরে ঢুকে খিল দিল।শাশুড়ী বাসন মাজছিল , ছোট বৌ এর আর কণ্ঠ শুনতে না পেয়ে টিউবয়েলের ঘর থেকে চিৎকার করে বলল - মেজ বৌমা দেখো তো ছোট বৌমা মনে হয় ঘরে খিল দিল…..
শাড়ীর আঁচল দিয়ে বাঁধা কোমর ঝুঁকিয়ে উঠান ঝাট দিতে দিতে মেজ বৌ বলল - ওই নাটুকে মাগীর নাটক ঢের দেখেছি,আমার মেলা কাজ বাকি পড়ে আছে,আমি পারব না, গরজ থাকলে আপনি মাগীর মান ভাঙান। তারপর আরো জোরে শপাত শপাত করে ঝাট দিতে লাগলো। মনে হল যেন উঠানটাই বড্ড অপরাধ করেছে,তাকে ঝাটা পেটা করে গায়ের ঝাল মেটাচ্ছে বড় বৌ।
কিছুক্ষন পর ঘরের ভেতর থেকে পোড়া কাপড়ের গন্ধ আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার ! মেজ বৌ,শাশুড়ী ছুটে এলো,তাদের চিৎকারে আশে পাশের প্রতিবেশীও ছুটে এলো। অনেক চেষ্টায় দরজা ভেঙে ছোট বৌকে যখন ঘর থেকে বের করে আনা হলো তখন তাকে চেনার উপায় নেই! বড় জায়ের হাত ধরে কোনো রকমে বলল - দি ..দি .. আ মা র ছেলে মেয়ে দুটো দেখো । তারপর পোড়া চোখ দুটো স্থীর হয়ে গেল।মেজ যা বুকের ওপর আছড়ে পড়ে চিৎকার করে উঠলো - বোন তুই একি করলি?
কিছুদিন পর মেজ ভাই গ্রামের দোকান তুলে দিয়ে, জায়গা জমি বিক্রি করে বহরমপুরে চলে গেল। বৃদ্ধা মা বিমলের ছেলে মেয়েকে দেখার মতো ক্ষমতা নেই। সুতরাং বিমল তার দোকান লাগোয়া আরো দুটি ঘর বানিয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে এলো সেখানে। দোকান চালাতে চালাতে রান্না বান্না করা, ছেলে মেয়েকে খাওয়ানো,স্কুলে পাঠানো, তাদের জামা কাপড় কাচা , মনে হয় ভূতেও এত পরিশ্রম করতে পারেনা! অনেক শুভাকাঙ্খি খদ্দের পরামর্শ দিলেন - কি করবে ভাই বিমল, উপায় নেই এবার একটা বিয়ে করো। অন্তত ছেলে মেয়ে দুটো ভালোভাবে মানুষ হোক আর তুমিও একটু ফুরসৎ পাবে।এভাবে তুমিই তো কদিন পর মারা যাবে!নিজের শরীরের দিকে তাকাও একবার!সত্যি বলতে কি,যে বিমলের পরনের লুঙ্গিটা ভুঁড়ির উপর বাঁধতে হতো সেই লুঙ্গি এখন আর পাচঁ জনের মতোই সে পরতে পারে। দু মন ওজনের শরীর এখন দেড়মনও নেই। বিমল সবার এইসব কথায় তেমন কোন উত্তর দিত না। চুপ করে থাকত। কখনও কখনো কাউকে বলত - পরের ঘরের মেয়ে এসে অন্যের ছেলে মেয়েকে কেউ দেখে? সৎ মা কখনো আপন হতে পারে?
- তা তো ঠিকই।কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় বা কি!বলো?

বিমল কঠিন যন্ত্রনা ভরা মৃদু হাসি হেসে বলতো - দেখি যদ্দিন পারি করে যায়, আর ঘুরতে ঘুরতে কয়েকটা বছর বাদেই মেয়ে রান্নাবাড়ি শিখে ফেলবে। তারপর ছেলেটাও বড় হয়ে যাবে। মেয়ের বিয়ে দেব। তারপর ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌমা নিয়ে আসবো ঘরে। আমার আর চিন্তা কী! বৌমার রান্না খাবো আর দোকান চালাব!
দোকানের খুচরো হিসেব আর পাশের দোকানীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বিমল জীবনের হিসেবের খাতার একটি পাতায় নজর দিতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। সে ভুলে গিয়েছিল, সমাজ এতোটা পঙ্কিল হয়ে গেছে যে, যেখানে বাবা মায়ের দিন রাত কঠিন কঠোর তীক্ষ্ম নজর সত্বেও ছেলে মেয়েকে রক্ষা করা যাচ্ছেনা ,সেখানে মায়ের স্নেহ-মমতা বঞ্চিত, অসহায় বাবার বুড়িছোঁয়া সাহচর্যে সন্তানের কি অবস্থা হতে পারে! ফল ফললো অচিরেই। স্কুলে যাবার নাম করে ছেলে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, বিড়ি ,গুটখা খাওয়া ধরলো। অন লাইনে পড়ার নাম করে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে পাশের সেগুন বাগানে নোংরা সিনেমা দেখে, গেম খেলে দিন কাটায়।মেয়েটি মায়ের মতো। ভীষণ লাজুক আর মৃদুভাষী। কলেজে ভর্তি হলো। তারপর লক ডাউন। ইতিমধ্যে ফেসবুকে এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ অতঃপর প্রেম। তারপর একদিন বাজারে কিছু কেনাকাটি করতে যাচ্ছি বলে গায়েব! প্রথমে বিমল আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে মেয়ে গেছে কিনা একে একে ফোন করে খোঁজ নিল। কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। তারপর সবাই পরামর্শ দিল থানায় এফ আই আর করতে। জামা কাপড় পরে থানায় বেরোবে এমন সময় ফোনে টুং করে একটা মেসেজ এলো। বিমল ফোনটা খুলে দেখে স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে - এ নিউ মেসেজ ফ্রম বিনি। দ্রুত মেসেজ খোলে বিমল। বিনি লিখেছে- বাবা, আমাকে অনর্থক খুঁজো না,আমি একজনের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছি। আমি তোমাকে জানানোর সাহস পাইনি।জানি তুমি তাকে কোনোদিনই মেনে নেবে না। ভয় পেওনা, মুসলমানকে বিয়ে করিনি, আমাদের হিন্দুর মধ্যেও যাদের তুমি নীচু জাত বলো ,সেই নীচু জাতের ছেলেকেই বিয়ে করেছি। পুলিশ থানা করোনা,আমার বয়স এখন আঠেরো বছর সাত মাস!
বাবা, আমাদেরকে মানুষ করার জন্য কত অমানুষিক পরিশ্রম করেছ, জীবনে ভুলবোনা। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তুমি সুস্থ থেকো। আর পারলে আবার একটা বিয়ে কোরো। আমাদের কত অন্যায় আবদার তো তুমি মেনে নিয়েছ বাবা ,আমার শেষ আবদার টুকু মানতে পারো না? জীবনে কোনোদিন আর কিছু চাইব না! প্লিজ!বাবা পারবে না আমাদের মেনে নিতে? বিমল ধপ করে বসে পড়লো। রাতে কিছুই খেলোনা। ছেলেটি অনেক রাতে ফিরে বাবাকে জিজ্ঞেস করল - বাবা, দিদির কোন খোঁজ পেলে? বিমল শুধু বলল- না। কিছুক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটি,তারপর রান্না ঘরে ঢুকে একটা বিস্কুট মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জলের বোতল নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

সকাল হতেই গ্রামময় ঘটনাটি রটে গেল। মুসলিমরা বলল - মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, বিমলের মেনে নেয়া উচিৎ। বিমলের স্বগোত্রীয়রা রে রে করে উঠলো। এই বিয়ে মেনে নিলে তারা দোকান বয়কট করবে। শাসক দলের প্রধান বিমলকে আড়ালে ডেকে ফিস ফিস করে পরামর্শ দিলেন - শোন,মেয়ে জামাইকে ভালোভাবে ডাক । তারপর থানার বড় বাবুকে আমি বলে রাখছি , জামাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে এমন প্যাঁদানি দেব ব্যাটা পালাতে পথ পাবেনা।আর মেয়ে তো তোর কবজায় থাকছে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেভাবে হোক ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে নেব। এটা গোপন পরামর্শ সুতরাং গোপন ই থাকলো। বিমলের স্বগোত্রীয়দের দোকান বয়কট করার কথা শুনে পাড়ার মুসলমানরা বলল - ওই তিন ঘর খদ্দের লিয়্যা তুমি কি ধুয়্যা পানি খাবা নাকি! আমরা তুমার সাথে আছি। চিন্ত্যা করো না। কদিন যাইক রাগ মিটলেই সব ঠিক হয়্যা যাবে!
বিমলের মনের আগুন নিবলো না। থানা পুলিশ ও করলো না। ভাবলো, ছেলেটি হয়ত মার খেয়ে পালাবে কিন্তু মেয়েকে সারাজীবন কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হবে। তারচেয়ে বরং তুই তোর মত থাক,ভাবব আমার মেয়ে মরে গেছে।
একটা বছর কেটে গেল এইভাবেই। মেয়েকে মেনে নিতেও পারলো না আবার মন থেকে দূরে সরিয়েও দিতে পারলো না। রাতে স্বপ্ন দেখে সেই ছোট্ট মেয়েটি বাবা বাবা করে ডাকছে। আঁতকে উঠে বসে। আবার ভাবে - না না এ অসম্ভব! নিচু জাতে বিয়ে! তুই কি করলি মা! একটা স্বজাতের ভিখিরি ছেলেও কি খুঁজে পেলিনা! মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।

স্বজাতীরা প্রায় সবাই দোকান অঘোষিত বয়কট করলো। আত্মীয় স্বজনদের শান্তনা বা যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেটি বয়সে চোদ্দ বছর হলেও তার দিকে তাকানো যায় না। চুল আর সদ্য গজিয়ে ওঠা গোঁফ দাড়ির বাহারী ছাঁট বলিউডের ভিলেনরা দেখলেও তাকে গুরু মানবে!
বিমলের চারিদিক শূন্যতায় ভরা, কেবল মৃত স্ত্রীর প্রতি মাঝে মাঝে অভিমানে বুকটা ভরে যায়! দেয়ালে টাঙ্গানো দুজনের বিয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে- ' সুনন্দা, নিজে পুড়ে তো শেষ হয়েছ, আমার আগুন কবে নিভবে বলতে পারো?

আরও একটা বছর কেটে গেল।

সব দিক ভেবে চিন্তে বিমল দেখলো, নাহ্ দ্বিতীয় বিয়ে করতেই হবে। খোঁজ শুরু হলো। নারায়নপুরে একটি স্বজাতের মেয়ে পাওয়া গেল। কিন্তু হঠাৎ বিয়ের আগের দিন খবর এলো - পাত্রের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হয়ে গেছে, এত বয়সের পুরুষকে বিয়ে করতে মেয়ে রাজী নয়! খবরটি পেয়ে বিমল স্মিত হাসি হাসলো। যে মেয়ে দশ দিন আগে সামনে বসে তাকে দেখলো, কথা বলল, সে হঠাৎ বয়সের অজুহাতে বেঁকে বসেছে? আর আঠাশ বছরের মেয়ে সেকি আজ আঠেরো বছরের যুবতী হয়ে গেল! দমকা বাতাস কোনও বন্ধ দরজা হঠাৎ যেমন খুলে দেয় ঠিক তেমনি বিমলের অন্য একটা চোখ খুলে দিল। নিমেষে মেয়েটির উপর যে রাগ অন্তরে ফোঁস্ করে উঠেছিল তা অন্য আরেক দিকে মোড় নিলো। স্বজাতের বিরুদ্ধে ঘৃণায় বুক ফেনিয়ে উঠলো। এত বড় শত্রুতা! দোকানে আসা বন্ধ করেও গায়ের ঝাল মেটেনি! ছি!

বিমলের অন্তরঙ্গ বন্ধু জয়নুল প্রায়ই দোকানে আসতো। একসঙ্গে একই পাড়ায় দুজনের বেড়ে ওঠা, খেলা ধুলা, আম লিচু চুরি সবই দুজনে করত এক সময়। বিয়ের পর দুজনের আড্ডা দেবার সময় কমেছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। হয় কথায় নয় কথায় সেইই বারবার বলে এসেছে- বিমল বিয়ে কর, বিয়ে কর। আজ সে দোকানে ঢুকে একটা বিড়ি নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে এক্ গাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল- কিরে ক্যামুন আছিস? আর কি কোনও মেয়্যার খোঁজ পালি?

নিজের বসার চেয়ারটা জয়নুল কে বসার জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল- না রে, কত আর খুঁজব! আর খুঁজেও লাভ নেই। পরপর তিনটে বিয়ে স্থির হয়েও ভেঙে গেল! বিয়ে ওরা হতে দেবেনা। তার চেয়ে আমাদের আশে পাশের যারা আমাকে চেনে জানে তাদের মধ্যে খুঁজে দেখ। এমন কি তোদের মধ্যেকারও যদি তেমন মেয়ের খোঁজ পাস বলিস বিয়ে করব!
- বুলিস কী?
- সত্যিই বলছি। বিশ্বাস কর।
- আচ্ছা বিশ্বাস করনু তোকে। কিন্তু হঠাৎ তোর এরম মতি ক্যানে? ভিন জাতে তোর মেয়্যা বিহ্যা করলো বুল্যা তাকে তুই মানলি ন্যা, আর সেই তুই ভিন জাতে বিহ্যা করবি! উহু, মুনে হ্ছে ডালমে কুচ কালা আছে!
জয়নুলের বিড়ির আগুন নিভে গিয়েছিল। বিড়ির মাথার পোড়া অংশ থেকে ছাই গুলো ঝরিয়ে পুনরায় নতুন করে আগুন জ্বালালো। বিমল বলল- জাতের পিন্ডি। নিকুচি করেছে জাতের। বিপদের দিনে যারা আরও বিপদে ফেলে তাদের ..... কথা শেষ হলো না। খদ্দের আসায় খদ্দের কে মালপত্র দিতে শুরু করলো বিমল। খদ্দের বিদায় হলে বিমলকে জয়নুল বলল-
- বুঝলি, তোর লায়েক বিটিছেল্যা আমাধের মধ্যে পাওয়া যাবে না।
- কেনো?
- টাটকা তরতাজা সব্জির যেমুন সকাল বেলায় কদর থাকে বেলা বাড়ার পর নেতিয়ে গেলে কেহু আর সেগুলা লিতে চাহেনা তেমনি আমরাও চোদ্দ পনের হলেই বিটি ছেলা গুলোকে পার করে দিই ..... তুই তো গাঁয়ের মানুষ , জানিস তো সবই। তোখে খুল্যা সব বুলার দরকার আছে?
- ঠিক আছে , তুই তো ধান গমের ব্যবসার সূত্রে পাড়াগাঁয়ে ঘুরিস, দেখিস খোঁজ পেলে জানাস। আমার বয়সের সাথে মানান সই মেয়ে হলেই হবে।

পাড়াগাঁয়ে ঘোরার কথায় জয়নুলের হঠাৎ মনে পড়ে যায় একটি মেয়ের কথা। বলল - থাম থাম একটা খুব ভালো মেয়্যা আছে দাস পাড়ায়। মুচির মেয়ে। ভীষণ ভালো মেয়্যাডা। রূপেগুনে সবদিকে সুন্দর। কমতি বলতে গায়ের রংডা একটু শামলা। যদি জাত বিচার না করে বিহ্যা করিস তবে খোজ খবর লিবো।
বিমল বলল - কিচ্ছু না, মেয়েটি সংসারী হলে, এই লক্ষ্মী ছুঁয়ে বলছি বিয়ে করব। দেখিস বদ মেজাজী যেন না হয়।সত্যি বলতে কি অনেক ভেবে দেখেছি এই জাতপাত সব মানুষের স্বার্থের জন্য বানানো। জাত দুটো,এক নারী আর এক পুরুষ। জয়নুল নিরক্ষর হলেও দশ গাঁয়ে বেড়ানো ছেলে সুতরাং বেশ চৌকস জ্ঞানের অধিকারী! বলল - তোর এমন পরিবর্তন ক্যামুন কর্যা হলো?
বিমল বলল - তোর বৌদি মরে অনেক গুলো শিক্ষা আমাকে দিয়ে গেল! তার মধ্যে এটা একটা। সেদিন শরীর ভালো যাচ্ছিল না। বিছানায় শুয়ে তার কথা বার বার মনে পড়ছিল। মনকে অন্য দিকে ফেরাতে কানের কাছে রেডিওটি চালিয়ে দিলাম। গান বাজতে শুরু হলো সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। সত্যি বলছি জয়নুল গানটি সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি, এতদিনে তার মর্ম খুঁজে পেলাম!
বছর দশেক হলো চামড়ার কাজ চলে গিয়েছে সনৎ রবি দাসের কিন্তু পার্শ্ববর্তী গঞ্জের নবীন মুখার্জীর উপর রাগ এখনো যায়নি। বিশ ত্রিশজন কর্মচারী নিয়োগ করে এই মামুদপুর এলাকাসহ চল্লিশ পঞ্চাশখানা গ্রামের পশুর চামড়া লরি বোঝায় করে কোলকাতার ট্যানারিতে পাঠায় নবীন বাবু। তার সাথে চামড়ার দরে পেরে উঠবে কে? নিজের লরি, নিজের ড্রাইভার! ফলে যে চামড়া মেরে কেটে সনৎরা পনেরশ টাকায় কিনতে পারে সেই চামড়াই নবীন বাবুর কর্মচারীরা আঠেরো 'শ , থেকে দু হাজার টাকায় ছো মেরে তুলে নিয়ে যায়। আর বেশি দাম পেলে জগতে এমন বোকা কে আছে যে সনৎদের প্রতি মায়া দেখিয়ে বলবে - না ভাই, দুশ পাঁচশ কম যাইহোক তোমাদেরকে ছাড়া চামড়া দেব না? প্রায় দিনই সনৎ পাশের পাড়ার ভাটি থেকে চুল্লু খেয়ে ফেরার পথে মোড়ের মাথার দুর্গা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নবীন বাবুকে গাল পাড়ে। শালা নবনে বামুন! আমার গায়ের ছোঁয়া লাগলে তোকে শুদ্ধ হতে হয়, আমার হাতের জল খাওয়া যায়না, আমার ছায়া পর্যন্ত তোর মাড়ানো যায়না কিন্তু, আমার জাত ব্যবসা তোর খাওয়া যায়! আর মা তোকেও বলিহারী! তোর ছোট ছেলের ভাত মেরে ঐ নবনে শালা মন্দির বানিয়ে দিল! তুইও সেই মন্দিরে চড়ে বসলি? মন্দির ঘুষ পেয়ে ঐ নবনেকেই আশির্বাদ আর কৃপা করে গেলি? তোর ছোট ছেলেগুলোর কথা একবারও ভাবলিনা? তারপর নিজেই নিজের কান মুলে দূর থেকে মন্দিরের প্রতিমার কাছে হাত জোড় করে বলে - মা মাগো, নেশা ভান করে কি বলতে কি বলে ফেলেছি ক্ষমা করে দিস মা! তুই তো মা। তুই অন্তর্যামী! বোকা ছেলের মুখের কথা বিশ্বাস করিসনি মা! টলতে টলতে বাড়ী ফেরে। মাতাল সনৎ কি জানে? এখন চামড়ার ব্যবসা কেবল মুচিরাই করে না। কোটি টাকার মালিক ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রাও করে। শুধু পুঁজি চায়, আর পুঁজি খাটিয়ে যে লক্ষ্মী লাভ হয় তারও কোনো জাত নেই! সেকি জানে যে বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে ক্রমেই গিলে খাবে এটাই জগতের নিয়ম! দেব-দেবীদের মন্দিরে নীচু জাতের মানুষ উঠলে অপবিত্র হয়ে যায় অথচ সেই দেবতাদের প্রণামী বাক্সে তাদের রক্তজল করা, টাকা, সোনা, গয়না ঢুকলে অপবিত্র হয়না!
সনৎ রবিদাসের এক মেয়ে দুই ছেলে। মেয়েটি বড়। আগে চামড়ার কাজের পাশা পাশি আরো একটা কাজ সনতের ছিল।তাতে উপরি রোজগার হতো। সাপের বিষ ঝাড়া। গোটা এলাকায় বেশ সুনাম ছিল সনৎ এর। দূরদূরান্ত থেকে সাপে কাটা রোগী আসত তার কাছে। প্রাঙ্গণে মনসা মন্দিরের সামনে রোগীকে বসিয়ে কাঁসার বাটিতে একটু জল নিয়ে তাতে একটা তামার পয়সা দিয়ে রোগীর পায়ে, বা হাতে স্থানে স্থানে ঠেকাত। রোগীকে জিজ্ঞেস করত - গরম না ঠাণ্ডা? আরেকটু সরিয়ে ঠেকিয়ে বলত- এখানে গরম না ঠাণ্ডা? তারপর শুরু হতো রোগীকে মাঝখানে বসিয়ে চার পাঁচ জনে ঘুরে ঘুরে সুর করে মা মনসাকে সন্তুষ্ট করার বিষহরি গান আর একবার সপাত করে সরু নীমের ডালের বাড়ি মারা। গান থামিয়ে মাঝে মাঝে বন্যগাছ গাচড়ার শিকড় বাকড় বেটে খাওয়াত।নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে দূর থেকে দূরে ভেসে যেত সেই গানের সুর। কখনো রোগী বাঁচত কখনো আস্তে আস্তে নেতিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। তখন মা মনসাকে আর আবেদন নিবেদন করতো না। শুরু হতো অকথ্য গালিগালাজ! সেই অশ্লীল গালিগালাজ সত্যিই যদি মা মনসা শুনতে পেতো তাহলে আলবত আত্মহত্যা করত। সুস্থ হয়ে ফেরা রোগীর আত্মীয়রা মোটা টাকা দান করত, আর যারা মারা যেত তাদের কাছে কিছু নিত না। বলত- আমরা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি কোন্ মুখে টাকা নিই। তবু কেউ জোর করে দু পাঁচশ গুঁজে দিত। বলত বাঁচা মরা উপর ওয়ালার হাতে, রাতভর তোমরা তো কম মেহনত করোনি, লজ্জা করোনা নাও। যা পেত তাতে দু চারদিন সংসার আর ক'দিন আয়েস করে চুল্লু খাওয়া হতো।এখন গ্রামে গঞ্জে তেমন সাপ ও নেই আর তাছাড়া বদনা হাতে করে রাতের অন্ধকারে ঝোঁপ জঙ্গলে বিশেষ কর্ম করতেও তেমন কেউ যায়না। সারা বছরে যে দু -এক জন সাপের কামড় খায় তারাও আর সনতের কাছে আসে না সোজা হাসপাতালে চলে যায়। বেচারা সনতের অবস্থা অবর্ণনীয়। ছেলে দুটো কেরালা খাটে। টাকা পয়সা দেয়না বাপ তাড়ি মদ খেয়ে শেষ করে দেবে বলে। তিরিশ বছরের বড় মেয়ে সপ্তমী বাঁশের ঝুড়ি, টুকরি বানায় তাই দিয়ে সংসার চলে। লেখা পড়ায় বেশ মেধাবী ছাত্রী ছিল সপ্তমী। গ্রামের স্কুলে মাধ্যমিক পাশ করে গঞ্জের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে কিছুতেই ভর্তি হলোনা। শিক্ষকরা বলেছিলেন - সপ্তমী তুই পড় আমরা সবাই মিলে তোর খরচ দেব। সপ্তমী বলল - স্যার, আমার পড়তে ভালো লাগে না। শিক্ষকরা আর জোর করেননি। তারা বুঝেছিলেন - আসলে পড়তে গেলে তার বৃদ্ধ বাবা মা কে দেখার কেউ নেই!
জয়নুল সপ্তমীকে বিমলের কথা বলল। সপ্তমীর বাবা মা তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। রোগ জর্জর মা বলল - বাবা জয়নুল, কেন গরীব কে মিচ্ছি মিচ্ছি স্বপন দেখাচ্ছ! ওরা আমদের চেয়ে উচুঁ জেতের । মেয়েটির বিয়ে নাহয় দিতে পারিনি তাই বলে এমন ভোগা কেন দিচ্ছ বাপ?
- মাসিমা আপনার গা ছুয়্যা আল্লার কির্যা খায়্যা বুলছি মিথ্যা লায়। একবার রাজী হোন। তারা বলল - দেখ সোপতির মত কি? কত বিয়ে এলো গেলো। আমরা রাজী করাতে পারিনি। সপ্তমী এবারো রাজী হচ্ছিল না। বাবা মায়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সুর নরম করলো। বাবা বলল - মারে তুই চলে গেলে আমরা কষ্টে থাকবো সত্যি কিন্তু থাকলে যে আরো বেশি কষ্ট পাই জানিস না? লোকে দিনরাত বলে - শালা সনৎ মাতাল মেয়ের বিয়ে না দিয়ে মেয়ের রোজগারে খাচ্ছে! আমরা কি কিছু বুঝিনা? কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে সনতের। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে - শেষ কথা শুনে রাখ, যদি বিয়ে না করিস তাহলে এবার দুই বুড়ো বুড়ি বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো। জয়নুল সপ্তমীকে বলল - পাগলী একটা, তুমি এতো চিন্তা করছ কিসের লাগ্যা? তুমি কি ভিন দ্যাশে চল্যা যাছো? ইপাড়া উপাড়ার ব্যাপার। দরকার হলে বিমল কে দুট্যা রান্ধ্যা দিয়্যা মা বাপের কাছে চল্যা আসো সারা দিনের মুতন। সপ্তমী বলল - ঠিক আছে জয়নুল দা ওকে আমাদের বাড়ীতে একদিন আসতে বলেন আমার কিছু কথা আছে।
জয়নুল ভেতরের উদ্বেলিত আনন্দকে গোপন করে গম্ভীর ভাবে বলল - ঠিক আছে কাল সন্ধ্যার সুমায় অকে লিয়্যা আসবো।
বাঁশ বাগানে ঘেরা সুন্দর ছোট্ট টালির বাড়ী। বাইরে বাঁশের বাতার বেড়া দিয়ে ঘেরা বারান্দা ঘরে জয়নুল আর বিমলের চা পান শেষ হলে জয়নুল বলল - দিয়াশালাই ফেল্যা আস্যাছি যাই ভিতর থেকে বিড়িডা ধরিয়ে আনি
সপ্তমী বলল - না না আপনি বসুন আমি দেশলাই আনছি।
- ধুর পাগলী, এখানে বস্যা বিড়ি খালে তুমার বাবা মা ভাববে হবু জামাই বিড়ি খাচে! তার চাহ্যা আমিই যাই ভিতরে । বিড়ি ধরান্যা ও হোবে তুমার বাপ মার সাথে দুট্যা গল্প করাও হোবে। বুদ্ধিমতী সপ্তমী বুঝে গেল এটা আসলে জয়নুলের তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার নিখাদ ছলনা! বিমলের সামনে লজ্জায় সে কুণ্ঠিত হয়ে গেল। মাথা নীচু করে মাটির মেঝের দিকে তাকিয়ে হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখ খুঁটতে লাগলো। কয়েকবার মনে হলো ছুট্টে পালায়। আবার ভাবলো সে নিজেই তো তাকে ডেকে এনেছে। পালায় কোন্ মুখে!এমন তো নয় সে অপরিচিত! স্কুলে পড়ার সময় কতোদিন তো তার দোকানে খাতা পেন কিনতে গেছে! কেন তাকে ডাকতে গেলো! কি বলবে কোনো কথাই ভেবে পাচ্ছে না! হয়ত আর কিছুক্ষন এমন থাকলে সেও কোনো অজুহাতে পালাত কিন্তু বিমল হঠাৎ বলল - যেভাবে নখ খুটছ এবার নখ ছিড়ে রক্ত না বের হয়ে যায়! সপ্তমী নিমেষে নখ খোটা বন্ধ করে দিল এবং নিজের অবচেতন কর্মের জন্য লজ্জায় ফিক্ করে হেঁসে ফেললো। বিমল বলল - লজ্জা কিসের বসো, আমি তোমার অপরিচিত নই।
তুমি কিছু জানতে চাও আমার কাছে? প্রাণ খুলে বলো, কোনো সংকোচ রেখোনা।

কিছুক্ষণ মৌন ভাবে থেকে সপ্তমী বলল- দেখুন আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা ছিলনা। বাবা মায়ের পীড়াপীড়ি আর পাড়ার লোকের গঞ্জনায় আমি অতিষ্ঠ। একে আপনি নিজেকে আমাদের চেয়ে উচুঁ ভাবেন আর তাছাড়া এতদিন বিয়ে করিনি, অনেক বিয়েই আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন লোকে বলবে - এতদিন বিয়ে করলো না, সপ্তমী এখন বড়লোক দেখে বিয়ে করতে বসেছে, জাতে উঠবে, কতকি!
বিমল বলল - দেখ ,বিয়ের জন্য আমি তোমাকে বাধ্য করছিনা। এটা বাধ্য করার বিষয় ও নয়। আর জাত নিয়ে আমার এখন আর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। এটুকু বুঝেছি মানুষের যদি কোনো জাত থাকে তা হলো নারী আর পুরুষ। এর বাইরে কোনো জাত নেই।

- জাতে যদি বিশ্বাস নাই করেন তাহলে মেয়ে জামাইকে মেনে নিচ্ছেন না কেন?
বিমলকে আচমকা কেউ যেন ধাক্কা দিলো। হঠাৎ করে এই রকম কঠিন প্রশ্নের মুখে যে তাকে পড়তে হবে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। জাত বিচারের প্রশ্নের উত্তরে বিমলের হৃদয় আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠেছিল, এই প্রশ্নে যেন হৃদয় নিমেষে সঙ্কুচিত হয়ে গেল! বিমল বলল - যে অপরিসীম দুঃখ যন্ত্রনা সহ্য করে যাকে লালন পালন করলাম আর সে কিনা এইভাবে .... বিমল চুপ করে বেদনা ভারাক্রান্ত কন্ঠ সে আড়াল করলো বটে কিন্তু তার যন্ত্রনা ক্লিষ্ট মুখটি দেখে সপ্তমী -বলল সবটা চোখে না দেখলেও কিছুটা অনুমান আমিও করতে পারি আপনার সেই কষ্টটা। সেটা বড় কথা নয়। বলুন মেয়ে জামাইকে ঘরে তুলবেন কিনা? হ্যাঁ অথবা না। বিমল বলল- শেষ বয়সে বিয়ে করছি তারা যদি এটা মেনে নিতে না পারে? তোমাকে যদি মায়ের মর্যাদা না দেয়?
- কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই, সেটা আমি বুঝব। আপনি মেনে তাদের নেবেন কিনা সেটা বলুন?
- আচ্ছা তোমার অভিমত কি জানতে পারি?
- আমার অভিমত, যদি তাদের মেনে নেন তবে আমি আপনাকে বিয়ে করব। যদি না মানেন তাহলে দুনিয়ার কেউ আমাকে আপনার সঙ্গে বিয়েতে রাজী করাতে পারবে না। এমনকি আমার বাবা মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও না!
বিমল বলল - দু বছর থেকে মেয়েটাকে দেখার জন্য আমিও খুব হা পিত্যেস করছি বিশ্বাস করো। আমি রাজী আছি তোমার প্রস্তাবে।
সপ্তমী কিছুক্ষন মৌন থেকে বলল - তাই নাকি? তা মশাই যাদের সামনে বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, বিমলের দেহে প্রান থাকতে মেয়ে জামাইকে মেনে নেবনা, তাদের কি জবাব দেবেন? উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই সপ্তমী অদ্ভুত এক মোহিত করা চাউনি দিয়ে বিমলের দিকে তাকিয়ে বলল- নিশ্চয় বলবেন কি করব নতুন বৌয়ের আবদার! তাইনা? হয়ত বিমল এমনি কিছু একটা মনে ভেবে রেখেছিল। সপ্তমীর এমন বুদ্ধিদীপ্ত বাচন ভঙ্গি আর বাঁকা চোখের অদ্ভুত চাউনিতে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলোনা,
মুহুর্তে সপ্তমীর হাতটি ধরে ফেলল। বলল - সপ্তমী তুমি বাঁচালে আমাকে, আমাকে কথা দাও খালি হাতে ফেরাবে না? সত্যি করে বলো আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
- ইসস্ কি করো! ছাড়ো! কেউ দেখে ফেললে কি বলবে!
বিমল আরো শক্ত করে ধরে সপ্তমীর হাত দুটি। জোর ঝটকা দিয়ে সপ্তমী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে- যাও জানিনা বলে এক দৌড়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে গেল।

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post