ইন্ডিয়ান ক্রিকেটাররা প্রত্যেকেই রঞ্জি ট্রফি বা দলীপ ট্রফির মতো খুব কোয়ালিটি ডোমেস্টিক ক্রিকেটের ফসল এটা বোঝার মানসিকতা বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রশাসনের আছে কি

     
                                                             লিখেছেনঃ  আনন্দরূপ,

       ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সিরীজটা একপেশে ভাবে ভারতের পক্ষে শেষ হওয়ার যে কারনগুলো আমার মনে হচ্ছে সেটা শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যে নয় সামগ্রিক ভাবে টেস্ট ক্রিকেটের জন্যেই বেশ খারাপ। ইডেনের মতো হাই প্রোফাইল ভেনু, পিঙ্ক বলে ভারতের প্রথম ডে নাইট টেস্ট এগুলোতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যেও গৌরবের হতে পারতো। সৌরভ গাঙ্গুলী সেই সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট তার কোনো মূল্যই দিতে পারলো না। টেস্টগুলো হারার মূল কারন অতি সাধারন বোলিং আর ততধিক কুৎসিত ব্যাটিং এটা বলবার জন্যে কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। হারজিৎ খেলারই অঙ্গ কিন্তু হারার মধ্যেও একটা লড়াই থাকবে তো! বাংলাদেশ যা করছে এটা লজ্জাহীন আত্মসমর্পন ছাড়া আর কি বলা যায়? ক্রিকেটকে দেশপ্রেমের একমাত্র মানদন্ড হিসাবে যারা গন্য করে তারা হাই লেভেলের বলদ ছাড়া আর কিছু না কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে জাত্যাভিমান জিনিসটা খারাপ সময়ে সেরাটা বের করে আনে, মোটিভেশনের কাজ করে। এই বাংলাদেশী প্লেয়ারগুলোকে দেখে মনে হয়েছে নিজের দেশের লিগ্যাসীটা সম্পর্কেই এদের কোনো ধারনা নেই। স্রেফ একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ বেদীটা চোখ বন্ধ করে মনে করলেই তো চোয়াল শক্ত করবার মতো একটা প্রেরনা পাওয়া যায়। এদের সেই জায়গা থেকে চিন্তা করার মতো মানসিকতা বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই।

  সারা সিরীজে স্রেফ দুইবার মাত্র মনে হয়েছে বাংলাদেশও ক্রিকেটটা খেলছে, একবার প্রথম টি টোয়েন্টি ম্যাচের সময়ে আরেকবার যখন ইডেন টেস্টে তায়জুল ইসলাম উড়ে গিয়ে বাউন্ডারী লাইনে বিরাট কোহলীর ক্যাচটা ধরলো তখন। ১৯৮৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও ভারতের এইরকম ভয়াবহ পারফরম্যান্স হয়েছিলো কিন্তু তাতেও সিধু, মঞ্জরেকর আর রবি শাস্ত্রীর তিনটে সেঞ্চুরী ছিল। কপিলদেবের তিন টেস্টের সিরীজে ১৮ টা উইকেট ছিলো কিন্তু এই বাংলাদেশ টিমের বলার মতো কোনো ইন্ডিভিজুয়াল পারফরম্যান্সও নেই।
     
      প্রশ্ন হলো এই খারাপ ব্যাটিং বোলিং এর কারন কি? সবচেয়ে বড় কারন মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রশাসনে কোনো ভালো লোক নেই। যারা আছে তাদের কোনো গ্রহনযোগ্যতা সেই দেশের ক্রিকেটারদের কাছে নেই। আর তার মূল কারন কিসে বা কি করলে তাদের দেশের ক্রিকেটের ভালো হবে সেই বোধ বা দূরদর্শিতাটাই এই লোকগুলোর নেই। যে কোনো দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেমন খেলবে সেটা তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো আর মানের ওপরে নির্ভর করে। টি টোয়েন্টি ক্রিকেট কর্পোরেট ক্রিকেট ব্যাবসায়ীতের লাভের ঝুলি ভরিয়ে দিলেও মূল ধারার সত্যিকারের ক্রিকেটের সর্বনাশ করে দিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন এখন ক্রিকেট বিশ্বে যে হাতে গোনা কয়েকটা দেশ লংগার ফর্মাটের ক্রিকেটে ভালো খেলছে যেমন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলীয়া, ভারত আর কিছুটা নিউজিল্যান্ড এদের প্রত্যেকের ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনদিন, চারদিন বা পাঁচদিনের ম্যাচকে ভীষন গুরুত্ব দিয়ে খেলা হয়। ওয়ার্নার, খোয়াজা, স্মিথ, স্টার্ক, রুট, এন্ডারসন, ব্রড, উইলিয়ামসন, ল্যাথাম, বোল্ট থেকে শুরু করে ভারতের কোহলী, রোহিত, রাহানে, ঋদ্ধি, ইশান্ত, শামি এরা প্রত্যেকেই লং ফর্ম্যাটের ক্রিকেটের ফসল। চাটনী ক্রিকেট বা ললিপপ ক্রিকেট থেকে এই মানের প্লেয়ার তৈরী হওয়া অসম্ভব এবং এরা প্রত্যেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন চারদিনের ক্রিকেটগুলোকে ভীষন গুরুত্ব দিয়ে খেলে। উল্টোদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিন আফ্রিকা, পাকিস্থানের মতো দেশগুলোতে যেখানে ক্রিকেটে প্রচুর কালো টাকা খাটে সেইদেশগুলো সনাতন ক্রিকেটের শেকড়টা উপড়ে দিয়ে সস্তা টি টোয়েন্টি বা কাঁচা পয়সার প্রিমিয়ার লীগগুলোর জন্ম দিয়েছে আর লং ফর্ম্যাটের ক্রিকেট শেষ করে দিয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পারফরম্যান্সেরও অন্তর্জলী যাত্রা হয়ে গেছে। টেকনিক আর মানিসিকতারও দফারফা করে ছেড়ে দিয়েছে কুড়ি বিশের ক্রিকেট। 
     বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানগুলো সব আউট হয়েছে শরীর থেকে দূরে বলগুলোকে খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে। এই জঘন্য ফুটওয়ার্ক আসলে স্ট্রাইক রেট সর্বস্ব ক্রিকেট সংস্কৃতির পরিনতি। ঘরোয়া ক্রিকেটের ভালো পরিকাঠামো ছাড়া কোয়ালিটি প্লেয়ার ওঠা অসম্ভব। ফাঁকিবাজী দিয়ে টেস্ট প্লেয়ার আসে না। শুরুর দিকে ঠিকঠাক এগোলেও এখন মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটেও এই ক্যাসিনো ক্রিকেট ভালো মতো গেড়ে বসে ঘরোয়া ক্রিকেটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যে ভারতীয় ক্রিকেটারদের হাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ল্যাজে গোবোরে হচ্ছে সেই ইন্ডিয়ান ক্রিকেটাররা প্রত্যেকেই রঞ্জি ট্রফি বা দলীপ ট্রফির মতো খুব কোয়ালিটি ডোমেস্টিক ক্রিকেটের ফসল এটা বোঝার মানসিকতা আমি জানি না বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রশাসনের আছে কি না। এই বাংলাদেশী প্লেয়ারগুলোর লংগার ফর্ম্যাটে ক্রিকেট খেলবার মানসিকতাই নেই। মুস্তাফিজুর একবার খোলাখুলিই বলেছিল ওর টেস্ট খেলতে ভালো লাগে না। তো এদেরকে জোর করে খেলিয়ে কি লাভ? একই অবস্থা অতীতে লাসিথ মালিঙ্গা আর পাকিস্থানের মহম্মদ আমীরেরও হয়েছে। তারওপরে ক্যাসিনো ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে প্লেয়ার কর্মকর্তা বচসা, শাকিবের নির্বাসন সহ একাধিক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে ওপার বঙ্গের ক্রিকেটাররা এখানে খেলতে এসেছে। মাঝে মধ্যেই মনে হয়েছে নেহাত অনেক আগে থেকে নির্ধারিত হওয়া ছিলো তাই খেলতে আসা এবং সফর শেষে কোন রকমে ফিরতে পারলে বেঁচে যাই এইরকম একটা মন থেকে এরা খেলছে। একদমই পরিকল্পনাহীন ছন্নছাড়া ক্রিকেট। নাহলে যেখানে অভিজ্ঞ তামিম ইকবাল আর শাকিব কেউই নেই তারওপরে ওপেনাররা টয়লেটে যাওয়ার তাড়া নিয়ে ক্রিজে নামছে সেখানে মশফিকুর আর মহামদুল্লাহ নিজেদেরকে আরো ওপরের দিকে তুলে ব্যাটিং করতে এলেন না কেন?
     ভারত বাংলাদেশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আসীন মাথা দুটোর দিকে তাকালেই দুটো দেশের ক্রিকেটের মানের পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ভারত যেখানে চারশোর বেশী আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সৌরভ গাঙ্গুলীকে ক্রিকেট প্রশাশনের মাথায় বসিয়েছে সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসনে নাজমুল হাসান পাপন নামের যে ব্যক্তিটি আছেন শুনেছি নিয়মিত ক্যাসিনোতে গিয়ে টাকা না ওড়ালে তার রাতে ঘুম হয় না। যেখানে ক্রিকেট প্রশাসনের মাথায় বসা সর্বোচ্চ ব্যাক্তিটিই জুয়া খেলতে পছন্দ করেন সেই দেশে দুর্নীতিমুক্ত পরিষ্কার ক্রিকেট হওয়া কার্যত অসম্ভব। আমরা কি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবো যে সৌরভ গাঙ্গুলী রাত্রিবেলায় কোথাও বসে জুয়া খেলছেন! সৌরভ প্রশাসনে মানে লংফর্ম্যাটের কাঠামোয় প্রভুত উন্নতি হবে। অনুর্ধ ষোল, অনুর্ধ উনিশ ক্রিকেটগুলোতে খুব জোর দেওয়া হবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে শচীন, হরভজন, কুম্বলে, লক্ষন এদের ক্রিকেট জ্ঞানের সদব্যাবহার হবে, IPL আর " বল খা গয়া " মার্কা ডাংগুলির পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেট থেকেও কি ভাবে পয়সা আনা যায় তার রাস্তাও বেরোবে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে এই দুঃস্বপ্নের সফর শেষ করে ঘরে গিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে যে তারা ক্যাসিনো ক্রিকেটকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচবে নাকি টেস্ট ক্রিকেটে কিছু করে দেখানোর জন্যে বদ্ধ পরিকর হবে।
আনন্দরূপ,ফেসবুক বন্ধু । 

Post a Comment

ধন্যবাদ

Previous Post Next Post